সালটা ১৯৪২। রাশিয়ার বুক ফুঁড়ে ঢুকছে জার্মান সেনা। যুদ্ধাস্ত্রে তাদের সাথে এঁটে উঠতে পারছে না মিত্রশক্তির কোনো দেশ। হাসপাতালে আহতদের চিৎকারে, ঘুম ভেঙে যায় এক সৈনিকের। সে আবিষ্কার করে, বন্ধুরা বলাবলি করছে, জার্মান অটোমেটিকের সামনে তাদের 'গাদা বন্দুক' হাতে লড়ার গপ্প। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই তাই মিখাইল কালাশনিকভ কারখানায় ফেরেন। লাল ফৌজের হাতে কয়েকদিন বাদেই একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অস্ত্র উঠে আসে। 'আভতোমাত কালাশনিকোভা'-৪৭। বাংলায় , কালাশনিকভের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। বা একে-৪৭।
'যন্তর'টি জার্মান অটোমেটিকের থেকে অনেকটাই হালকা। লুকিয়ে ফেলা যায় সহজে। ক্ষিপ্ৰ হাতে বদলানো যায় কার্তুজ। ট্রিগার চাপ দিলে বৃষ্টির মতো গুলি ছুটবে। ঝাঁঝরা করে দেবে ৩০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত যেকোনো লক্ষ্যবস্তকেই। লাল ফৌজের হাতবদলি হয়ে পৃথিবীতে প্রায় সমস্ত দেশের সৈনিকদের কাছেই ৪৭ নামটা বড্ড চেনা। ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর যুদ্ধে। বিভিন্ন বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, কিংবা বিভিন্ন সামরিক বিভাগে মিখাইল কালাশনিকভ নামটা সম্ভ্রমের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়।
চাষি বাবাকে সেই ছোটবেলায় সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল স্তালিনের সরকার। কুড়িয়ে বাড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠা মিখাইল ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়ে যোগ দিল যুদ্ধে। প্রথমে ট্যাঙ্কের মেকানিক পরে কমান্ডার। অস্ত্রের ব্যাপারে অদ্ভুত মাথা খেলে। কারখানায়, কার্বাইন-রাইফেল-রিভলভারে বুঁদ হয়ে থাকে সে…
যুদ্ধ শেষ। সেদিনের সেই সদ্য গোঁফ ওঠা আবিষ্কারক আজ নামজাদা মানুষ। একাডেমিতে লেকচার দিয়ে বেড়ান। ভূষিত হাজার হাজার সম্মানে। 'লেনিন পুরস্কার, 'স্তালিন পুরস্কার', সবই পাওয়া হয়ে গিয়েছে। সাফল্যের শিখরে ওঠা কালাশনিকভ ভাঙতে দেখেছেন সোভিয়েতকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন যুদ্ধাস্ত্রের ধরণ বদলেছে, তিনিও পাল্টে ফেলেছেন নকশা। প্রথম উন্নত 'সাবমেশিন গান'-এর জনক তিনিই।
যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কারের জন্য বাহবা পেতে পেতে, তিনি দেখছিলেন, গুলির আঘাতে শেষ হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। অত্যাচারী পুলিশ মিলিটারিদের থেকে আতঙ্কবাদী, মাফিয়াদের হাতেও ঝলসাচ্ছে কালাশনিকভ রাইফেল । এক প্রবল অর্ন্তদ্বন্দে ভুগতেন প্রৌঢ়। দোষ দিয়েছেন ফ্যাসিস্টদের। বলেছেন, "আমি কারিগর মাত্র। যুবাবয়সে নিজের দেশকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র গড়েছি… চেয়েছিলাম কৃষি খামারের জন্য ট্রাক্টর বানাতে। যুদ্ধ সে অধিকার কেড়ে নিল।" শেষবয়সে ঘৃণা উপচে পড়েছে, যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদদের উপর। তাঁর কথাতেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, "আমার রাত্রে ভালোই ঘুম হয়। কারণ দোষটা আমার নয়। বরং সেইসব যুদ্ধবাজ নেতাদের, যাঁরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস রাখেন না।"
বন্দুকের পেটেন্ট থেকে লভ্যাংশও তিনি গ্রহণ করেননি। মুখে হাজার সাফাই গাইলেও মানাতে পারেননি মনকে। তাঁর হাতেই তো লেগে প্রতিঘন্টায় গৃহযুদ্ধ-হামলায় খুন হওয়া মানুষগুলোর রক্ত। ভিয়েতনাম, ইরাক-ইরান , প্যালেস্টাইন, কার্গিল দুই পক্ষের হাতেই কালাশনিকভ। তাঁর বন্দুকের নল ঘুরিয়েই তো বদলাচ্ছে জগৎ। সামরিক আগ্রাসনের প্রতীক, একে-৪৭। দায় তিনি এড়াবেন কেমন করে? মানসিক অবসাদ তাই গ্রাস করেছিল বৃদ্ধকে। ভেতরে ভেতরে বারংবার ভুগেছেন গ্লানিতে। তিনি তো চাষির ছেলে। চেয়েছিলেন বীজ বুনতে। 'মানুষ মারার কারিগর' হিসেবে বিখ্যাত হওয়ার কথা, স্বপ্নে ভেবেছিলেন কি?
মৃত্যুর ক'মাস আগেও চার্চকে চিঠি লিখেছেন মারণ অস্ত্রের আবিষ্কারক। সে চিঠিতে ছিল ঈশ্বরের কাছে একটি কাতর প্রশ্ন, "এতগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাণের জন্য কি আমিই দায়ী?"
যুদ্ধাস্ত্রে যদি একটা 'নোবেল' হত, তা হয়তো পেতেন তিনি। তবে আলফ্রেড নোবেল কিংবা আইনস্টাইন, কারো সৃষ্টিই নিস্তার পায়নি যুদ্ধের হাত থেকে। তাই কালাশনিকভ একশো বছর পেরিয়েও দিনের শেষে রয়ে যাবেন একজন বন্দুক আবিষ্কর্তা হিসেবেই।