বইটিতে ফ্রানৎস কাফকা-কে তুলনা করা হয় ড্রাকুলা-র সঙ্গে!

সাল ১৯৭৫ জিল দেলুজ (১৯২৫-১৯৯৫) ও ফেলিক্স গুয়াচারি (১৯৩০-১৯৯২) যৌথ ভাবে লিখলেন ‘কাফকা, টুওয়ার্ড এ মাইনর লিটরেচার’। মূল বইটি ফরাসি ভাষায়,  ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় তারও এগারো বছর পরে  (১৯৮৬) 

            

উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিক হিসেবে দেলুজ-গুয়াচারি দুনিয়া-কাঁপানো জুটি সাহিত্য নিয়ে একটি অভিনব প্রস্তাব (‘মাইনর লিটারেচার’) তাঁরা পেশ করেন এবং কতিপয় লেখককে খুঁজে পান সেই গণ্ডিতে...  ফ্রানৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) এখানে দেলুজ ও গুয়াচারির উত্তেজনার কেন্দ্র; দুজনেই মনে করেন কাফকা ছিলেন উক্ত ‘মাইনরিটি’র একজন, ‘কাফকা-সাহিত্য’ – মাইনর লিটারেচারের নমুনা।    

 

আরও পড়ুন
‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী সাহিত্যের পণ্ডিতরা’, কিশোর কবির আত্মহত্যার পিছনে কোন রহস্য?

বৈপ্লবিক – এ ছাড়া কোনও বিশেষণ চলে না, কাফকা-ব্যাখ্যার অন্তে যে-কটি সিদ্ধান্ত টানা হয় – সেগুলি সম্পর্কে।  ...নির্জন ও অসুখী এক যুবক, চল্লিশ বছরেই যাঁর ‘শেষ’, পরিবার ও বিয়ে দুটি বিষয় নিয়েই ভয়াল কমপ্লেক্স, অসুখবিসুখ নিয়ে বাতিক আর উদ্বেগ, লেখাকেই যিনি ভাবেন কেবল ‘আত্মার মুক্তি’ – তাঁকে নিয়ে চলতি ধারণার শেকড়সুদ্ধু উপড়ে তুলেছেন এই জুটি।   

 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পর সমস্ত লেখা পুড়িয়ে দিতে বলেছিলেন কাফকা, অনুরোধ রাখেননি বন্ধু

কাফকা লোকটি আদৌ তত সাত্ত্বিক নন, যতটা লোকে ভেবেছে! দেলুজরা বলছেন, তিনি আসলে একজন ছুপা-‘অয়দিপাউস’, পুরাতন ট্র্যাজিক নায়কের এক আধুনিক সংস্করণ -  যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছে। ‘সব দোষ আসলে বাবার।’ ... ‘যদি আমি যৌনভাবে অক্ষম হই? যদি আমি লিখতে না পারি? যদি বিয়ে না হয় আমার?’ - পিতাকে আর হাতে-নাতে হত্যা নয় বরং নিজের কলঙ্ক সাফ করে দেওয়াই লক্ষ্য। 

 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ থেকে সন্দীপন, বাংলা সাহিত্য মহামারীর সাক্ষী থেকেছে বরাবরই

‘মেটামরফোসিস’ গল্পের গ্রেগর কিংবা ‘জাজমেন্ট’ গল্পের জর্জ – সকলেই হচ্ছে ভিকটিম, পতঙ্গ-গ্রেগরকে আপেল ছুঁড়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন তার বাবা, নিরাপরাধ জর্জকে জলে ডুবে মরতে আদেশ করেন পঙ্গু পিতা। ...ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল পিতাকে নিয়ে ক্রাইসিস, বাবা হেরম্যান কাফকা ছিলেন রীতিমতো সফল, বিত্তবান ও জাঁদরেল – যেখানে ছেলে অনেকটাই মিনমিনে, প্যাসিভ।  ‘ছোটবেলায় টেবিল-পাক দিয়ে আমায় তাড়া করতে তুমি আর হুমকি দিতে, ‘সার্ডিন মাছের মতো টুকরো করে দেব’, স্নেহও বড় কম করতে না’... বাবা-কে লেখা ছেলের অভিমানী চিঠি, জীবদ্দশায় দেওয়া হয়নি; পরে বই হিসেবে বেরোয় ‘লেটার টু মাই ফাদার’ নামে।

 

আরও পড়ুন
অস্থির সময়ের প্রতিবাদ সাহিত্যেই, নতুন ইস্তাহার প্রকাশ বাংলার সাহিত্যিকদের

চিঠি লিখতে ভালবাসতেন, প্রেমিকা ফেলিস ও মিলেনাকেও অনেক চিঠি লেখেন কাফকা (সংকলন ‘লেটারস টু ফেলিস’ আর ‘লেটারস টু মিলেনা’ দ্রষ্টব্য)। এই চিঠিগুলো খুব নির্দোষ চিঠি নয়, এগুলো ছিল কাফকার অভিসন্ধির অঙ্গ – মনে করছেন দেলুজরা।  

 

একটা নিঃসঙ্গ মাকড়সার মতোই জাল বুনে গেছিলেন কাফকা, ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এক গোপন নেটওয়ার্ক। - ১৯২৪ সালে যক্ষ্মায় ভুগে যাঁর মৃত্যু, অপরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের পথটি করে দিত ‘চিঠি’ই। যেন একটা ভ্যাম্পায়ারের মতো অন্যের রক্ত চুষে কাফকা বেঁচে উঠতে চেয়েছিলেন, দেলুজ-গুয়াচারির বিস্ফোরক মন্তব্য – ‘There was something Dracula in Kafka’... ‘হ্যাঁ, কাফকার মধ্যে একরকম ড্রাকুলা লুকিয়ে ছিল!’ 

কৈশোর; ফ্রানৎস কাফকা

বরাবর নিরামিষ খেতেন কাফকা, ব্রাম স্টোকার সৃষ্ট ‘ড্রাকুলা’ – সেও নিরামিষাশী। কাফকার আকৃতি ছিল শীর্ণ, তাঁর গল্পের চরিত্র ‘অনশন শিল্পী’। ড্রাকুলার অবয়বটি মনে করুন, সে নিজে খেতও খুব কম। তার আসল খাদ্য - অন্যের গরম রক্ত! ...কাফকার উপন্যাসের নাম ‘দুর্গ’, ড্রাকুলাও থাকত একটা বিশাল দুর্গে। রক্ত চুষে আনার জন্য ‘ভ্যাম্পায়ার বাদুড়’ ছেড়ে দিত ড্রাকুলা, রাতের বেলায় তারা উড়ে বেড়াত, দিনে বন্দি হয়ে থাকত কফিনে। কাফকার বেলায় এই বাদুড়েরা ছিল আসলে কাফকারই লেখা চিঠি, ওগুলো সারাটা দিন থাকত লেখার দেরাজে, রাতের সময় সেই চিঠি মেলে ধরে পড়ত তার প্রাপক।

 

আপিসের ঠেলায় জেরবার যুবক গ্রেগর সামসা, যে কোনো না কোনোভাবে ছিল কাফকারই ভোল বদল। ... পোকা হয়ে যাওয়ার পর একলা ঘরে বন্দি সামসা, তাকে খাবার দিতে আসে যুবতী বোন। মিলটা দেখুন – চার সন্তানের মধ্যে কাফকাই ছিলেন একমাত্র ছেলে, বাকি তিনজনই কন্যা... বোন ওটলা ছিল কাফকার সবচেয়ে ন্যাওটা। ...পতঙ্গ-গ্রেগর চাইছিল বোনের কাছে আসতে, পরিবারের সবাই ডরালেও বোনই করুণা করে তাকে। গল্পে আছে - বোনের নগ্ন ঘাড়ে উঠে পড়েছিল কুৎসিত পোকাটি, ঘাড়ের তলায় গরম রক্তের প্রবাহ পেয়েছিল টের। 

 

কিংবা ভাবুন, ‘ট্রায়াল’ উপন্যাসে আসামি ‘কে’ প্রতিবেশিনী ফ্রয়লাইন বারৎসনারকে যখন চুমু খাচ্ছে, লেখক দিয়েছেন সেই চুমুর বর্ণনা, ‘তৃষ্ণার্ত জানোয়ার যেন অনেকদিন পর লোভীর মতো ঝর্নার জল পান করছে!’ 

 

দুটো জিনিসে ভয় ছিল ড্রাকুলা-র, ক্রুশচিহ্নে আর রসুনে।  কাফকাও অনুরূপে ডরাতেন পরিবারের পবিত্র দায়িত্বকে, (যা ছিল ক্রুশেরই মতো) এবং সাংসারিক বন্ধন (রসুন যার প্রতীক) - কাফকার আপাদমাথা জীবনে ও সাহিত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে একটি বিশাল প্লেট, দেলুজদের ঠাহর নির্দয় ‘এক্স রশ্মি’ ছুঁড়ে দিয়েছে, মেলে ধরেছে হাড়পাঁজর সমেত লুকোনো আস্ত কাঠামোটি      

 

ফেলিস বয়ার-কে কাফকা লিখছেন, ‘আমার হৃদপিণ্ডটা খুব দুর্বল, বুঝলে ফেলিস, আমার রোগা শরীরে সে রক্ত পৌঁছে দিতে পারে না, আমার দু’পায়ে বোধহয় কোনো রক্তই যায় না।’ ...এই যে চিঠিগুলো, এরাই কাফকাকে ‘রক্ত’ এনে দিত। অন্যের অপরাধবোধই হচ্ছে সেই ‘শক্তি’ যেখান থেকে তিনি লিখতে পারবেন, লেখার রসদ খুঁজে পাবেন। ‘লেখালেখি হচ্ছে শয়তানের কাছে মূল্য চোকানো’, কথাটা তাঁরই ডায়রিতে আমরা পাচ্ছি। 

 

জাতে চেক, কিন্তু লিখতেন জার্মান ভাষায় – যাতে ছিলেন মাতৃভাষার চেয়েও হয়তো সড়গড় নিজের ভাষা থেকে নিজেকেই নির্বাসন দিচ্ছেন - তবু কাফকা কি আসলেই ‘জার্মান’ লেখক? ধর্মে  ইহুদি, মেজরিটি যেখানে ক্রিশ্চিয়ান। গ্লানির বিষ মিশে ছিল রক্তে, নিজের জন্মকে ভাবতেন অভিশপ্ত, যেন এক আসামি... এখানেও কাফকা ‘সংখ্যালঘু’র দলে। জন্মভূমি বোহেমিয়া (পরে চেক প্রজাতন্ত্র), তবু স্বস্তি পাননি কোথাও, মানিয়ে নিতে পারেন নি, বারম্বার গিয়েছেন প্যারিস, বার্লিন... যেন বাসস্থলের খোঁজ, এক উদবাস্তুর মতোই!

 

যেমন ইশারা রাখা ছিল ‘ইন দা পেনাল কলোনি’ (১৯১৪) গল্পে – ‘কবর থেকে মৃত সেনানায়ক উত্থিত হবেন দলবল সহ’, কাফকার মৃত্যুর কিছু পরেই আসল মুখ দেখাবে নাৎসিরা। ক্রমে বেরিয়ে আসবে  নখদাঁত, প্রকাশ্যে পোড়ানো হবে ইহুদি আইনস্টাইনের মতো ইহুদি কাফকার বইও। বোন ওটলা বন্দি হবেন, খুন হবেন ডেথ ক্যাম্পে। প্রেমিকা ডোরা ডায়মন্ট, যক্ষ্মায়-ঝাঁঝরা কাফকার শেষ এক বছরের সাক্ষী, নাৎসি জমানায় তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হবে দেশ ছেড়ে, আশ্রয়ের খোঁজে... ডোরা-র সঙ্গে থাকবে ফ্রানৎসের সাতখানা নীল মলাটের খাতা আর শেষ দিনগুলির বিষন্ন মধুর স্মৃতি। 

 

মনোঃসমীক্ষণ, রাজনীতি, সমাজনীতি, ভাষাতত্ত্ব – কী নেই দেলুজ-গুয়াচারির অস্ত্রের ভাঁড়ারে! গোয়েন্দা-গল্পের চেয়েও যে স্বাদু হতে পারে তত্ত্বের বই, তাই বা কী ক’রে জানা থাকবে? গবেষণার হাপর-হাতুড়ি থেকে এমন স্ফুলিঙ্গ বাতাসে কমই ওড়ে ‘কাফকা - টুওয়ার্ড এ মাইনর লিটরেচার’ – সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।   

 

 

Kafka: Towards a Minor Literature. 

Gilles Deleuze, Félix Guattari

Trans. Dana Polan. 

Theory and History of Literature 30. 

Minneapolis and London: U of Minnesota P, 1986.

 

Powered by Froala Editor

Latest News See More