গত জুলাই মাস থেকেই ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেন ঘোষণা করেছিলেন, ৩১ আগস্টের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবে আমেরিকা। তবে ততদিনও অপেক্ষা করতে হল না। সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকেই পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তালিবান শক্তি। তবে তার ফলাফল যে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি সপ্তাহ দুয়েক আগে পর্যন্ত। একাধিক আফগান প্রদেশ দখলের পর এবার কাবুল দখলের পথেই হাঁটছে তালিবানরা। যা স্পষ্টতই আফগান সরকারের পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গতকাল আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ গজনি প্রদেশ চলে যায় তালিবানদের দখলে। এই নিয়ে সব মিলিয়ে ১০টি প্রাদেশিক রাজধানীর দখল নিল সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীটি। তার আগে বুধবার ফারা সিটি, ফৈজাবাদ, পুল-ই-কুমরি— এই তিনটি প্রাদেশিক রাজধানী দখল করেছিল তারা। আফগানিস্তানের এই চার গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানীর পতনই সরকারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিমত আন্তর্জাতিক কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের।
সদ্য তালিবান অধিকৃত গজনি প্রদেশের রাজধানী থেকে আফগানিস্তান রাজধানী কাবুলের দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। বর্তমানে ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছে তালিবান বাহিনী। পাশাপাশি গজনি প্রদেশের সামরিক ছাউনির দখলের পর আরও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও অনেকটা ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে তালিবান। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে গজনি-পতনের সঙ্গে সঙ্গে কাবুল-কান্দাহার এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগও বিপর্যস্ত হওয়ায়, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল। সদ্য-প্রকাশিত মার্কিন রিপোর্ট অনুযায়ী, তালিবান আগ্রাসনের এই গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই কাবুল সরকারের পতন একপ্রকার নিশ্চিত।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আগে, কাতারের দোহায় একাধিকবার যৌথ বৈঠকে বসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান এবং তালিবানরা। সেখানে দু’তরফের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল শান্তিচুক্তি। তবে মাস ঘুরতেই বদলে গেল গোটা পরিস্থিতিটাই। তালিবানদের সামরিক চাপে বাধ্য হয়ে গতকাল ক্ষমতা ভাগাভাগিরও প্রস্তাব দেয় গনি সরকার। ইতিমধ্যেই ২ মন্ত্রীর পদত্যাগ আফগান সরকারের অসহায়তাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
আরও পড়ুন
বিনা বাধায় আফগান শহর দখল, তালিবানদের অগ্রগতিতে আশঙ্কার মেঘ
বিগত সপ্তাহ খানেকের তালিবান দাপটে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় হাজারের বেশি মানুষ। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪ হাজার। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও। উদ্বাস্তু হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
আরও পড়ুন
রাস্তার ধারে বই বিক্রি থেকে বন্ধুত্ব, ভিন্নপথের দুই আফগানের গল্প
প্রশ্ন থেকে যায় কোটি কোটি টাকা দিয়ে সুসজ্জিত আফগান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা নিয়েও। যেখানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরেও সেনা খাতে খরচ বাড়ানো হয়েছিল প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার, সেখানে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল কেন দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগ? বিবিসি, আলজাজিরা-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। খাতায় কলমে সামরিক ব্যয়ের হিসাব দেখানো হলেও, সেই খরচ বাস্তবায়িত হয়নি অনেক ক্ষেত্রেই। এমনকি প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে সেনাদের, মিলছে সেই প্রমাণও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়েছেন বহু আফগান পুলিশ ও সেনা। সেইসঙ্গে জাতিবৈষম্যও যেন ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে আফগান সেনাবাহিনীর একতা। এমনকি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতেও ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান ওয়ালি মহম্মদকে অপসারণ করেছে গনি সরকার। সেনাবাহিনীর এই ব্যর্থতার পিছনে যে সরকারের সুস্পষ্ট দায় রয়েছে, তা ফুটে উঠছে প্রতি পদে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলির দমনের জন্য সরব হয়েছিলেন আফগান প্রেসিডেন্ট আসরাফ গনি। বর্তমানে চাপের মুখে পড়ে তাদের সঙ্গেই নতুন করে জোট করার কথাও চিন্তা করছে আফগান সরকার।
আরও পড়ুন
অবশেষে আফগান ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগী তালিবানরা!
কিন্তু সত্যিই কি এভাবে ঠেকানো সম্ভব হবে তালিবান আগ্রাসনকে? ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতায় ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল তালিবানদের। তারপর ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চললেও সাময়িক স্বস্তি পেয়েছিল আফগান জনজীবন। এবার সরকারেরই একাধিক ভুল সিদ্ধান্তে যেন আবার ফিরে আসতে চলেছে সেই অন্ধকার যুগ। এখন দেখার, আফগানিস্তানের এই অসহায়তায় পশ্চিমা শক্তিগুলি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কিনা…
Powered by Froala Editor