ঘুমের মধ্যে কোনোদিনও স্বপ্ন (Dream) দেখেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই বিরল। কিন্তু মানুষ কেন স্বপ্ন দেখে? তার গুরুত্বই বা কতটা? এ-সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আজও সঠিকভাবে দিতে পারেনি বিজ্ঞান। কিন্তু শুধুই কি মানুষ এই অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী? ষাটের দশকেই এই প্রশ্ন তুলেছিলেন একদল বিজ্ঞানীরা। যেখানে মানুষের স্বপ্ন-রহস্যেরই সুস্পষ্ট সমাধান হয়নি, সেখানে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আরও কঠিন। তবে সে-সময় থেকেই শুরু হয়েছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর সে-সব পরীক্ষার ফলাফলও বেশ চমকপ্রদ।
এই গল্পের শুরুটা করা যায় বিড়াল দিয়ে। ৬০-এর দশকের প্রথম দিক সেটা। এমআইটি-র গবেষক মিচেল জোভেট বিড়ালকেই বেছে নিয়েছিলেন গবেষণার বিষয় হিসাবে। ঘুমের মধ্যে যে-সময়টায় স্বপ্নের মায়াজাল বোনে মানুষ, সেই সময়টাকে গবেষকরা চিহ্নিত করেন র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা ‘আরইএম’ স্লিপ নামে। জুভেট লক্ষ্য করেন, বিড়ালের ‘আরইএম স্লিপ’-এর সময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় তাদের হৃদস্পন্দন। পাশাপাশি সংকোচন-প্রসারণ শুরু হয় বিড়ালের পেশিতেও।
জুভেট পাকাপাকিভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি ঠিকই। তবে ধারণা করেছিলেন, স্বপ্নের মধ্যে শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর পোষ্য বিড়াল। অন্তত পেশির ভঙ্গী নির্দেশ দিচ্ছে তেমনটারই। লাফানো বা দৌড়ানোর সময় যেভাবে সঞ্চালিত হয় পেশি, ঘুমের মধ্যে ঠিক সেভাবেই নড়াচড়া করে বিড়াল।
সে-সময় তাঁর এই গবেষণা যেমন একদল বিজ্ঞানীর প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তেমনই তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও কম হয়নি। নব্বই-এর দশকে তাঁর এই কাজ নিয়ে পুনরায় গবেষণা করেন মেক্সিকান গবেষক পেনা-গুজম্যান। তিনিও প্রায় একই মতামত জানান।
এর প্রায় এক দশক পর, আশ্চর্য একটি পরীক্ষা চমকে দেয় গোটা বিশ্বকে। ২০০১ সাল সেটা। এমআইটির নিউরোলজিস্ট ডঃ ম্যাথিউ উইলসন একটি গোলকধাঁধাঁর মধ্যে ছেড়ে দেন একটি বিড়াল ও ইঁদুরকে। তবে তিনি এমনভাবেই এই গোলকধাঁধাঁ তৈরি করেছিলেন যাতে চেষ্টা করেও বিড়ালের নাগালের মধ্যে না আসে ইঁদুরটি। প্রাথমিকভাবে বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটান উইলসন। এর দিন তিনেক পর ফাঁকা গোলকধাঁধাঁয় ঘুমন্ত অবস্থায় ছেড়ে দেন ইঁদুরটিকে। আর তাতেই ঘটে যায় ম্যাজিক। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই, কোনোরকম সংঘর্ষ ছাড়াই গোটা পথটি অতিক্রম করে ইঁদুরটি। উল্লেখ্য, প্রাণীরাও যে স্বপ্ন দেখে এবং বাস্তবের কোনো ঘটনাই যে ঘুমের মধ্যে তাঁদের স্নায়ুতন্ত্র করে সজাগ করে তোলে, তার অন্যতম প্রমাণ ছিল এই পরীক্ষা।
সম্প্রতি জেব্রাফিশ প্রজাতির একটি বিশেষ মাছ, মাকড়শা ও পাখিদের ক্ষেত্রেও এই একই ধরনের উদাহরণ লক্ষ করেছেন সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকরা। এমনকি স্নায়ুতন্ত্রের পালস সংগ্রহ করে তাঁরা দেখিয়েছেন, আরইএম ঘুমের সময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশের সক্রিয়তা। যার সঙ্গে স্মৃতিশক্তিরও যোগ রয়েছে ঘনিষ্ঠভাবে। বন্য প্রাণীদের ঘুম-দর্শনের ওপর ‘দ্য হিডেন ওয়ার্ল্ড অফ অ্যানিম্যাল কনসায়েন্স’ নামে একটি বিশেষ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সবমিলিয়ে প্রাণীরাও যে স্বপ্ন দেখে, এই তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা…
Powered by Froala Editor