আজ থেকে ঠিক ৭২ বছর আগের একটি দিন। ১২ আগস্ট। দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারতবর্ষ। আর ঠিক সেই সময়ে এক বিরল ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইংল্যান্ড। একটু একটু করে উঠছে ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। আর তার সঙ্গে শুরু হয়েছে নতুন জাতীয় সঙ্গীত। খেলা শুরুর আগেই যেন এক বিজয়ের আনন্দ এসে ঘিরে ধরেছে ভারতীয় হকি দলকে। কারণ উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ড। এতদিন যে দেশ পরাধীনতায় আবদ্ধ করে রেখেছিল ভারতবর্ষকে। যে জাতির পায়ের তলায় বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে তেরঙ্গা পতাকা, সেদিন সেই পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ইংরেজরা।
১৯৪৮ সালে সেবার ইংল্যান্ডেই আয়োজিত হয়েছিল অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। আর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই সেবার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতবর্ষও। ততদিনে ভারতের হকি দলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এর আগে পরপর ১৯২৮, ১৯৩২ এবং ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে সোনা জয় করেছে ভারতীয় হকি দল। কিন্তু সেবার খেলা হয়েছিল ইউনিয়ন জ্যাকের ছায়ার নিচে। অর্থাৎ ভারতীয় খেলোয়াড়দের প্রতিভার বিনিময়ে জয়ের শিরোপা পেয়েছিল ইংল্যান্ড। ১৯৪৮ সাল এনে দিল সেই হিসাব বুঝে নেওয়ার মুহূর্ত।
সেবার ভারতীয় হকি দল ছিল তারুণ্যে ভরপুর। একদিকে কৃষ্ণলালের মতো ক্যাপ্টেন আর অন্যদিকে বলবীর সিং-এর মতো তরুণ খেলোয়াড়, সব মিলিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য বাহিনী। অলিম্পিকের নক আউট পর্ব থেকে প্রতিটি ম্যাচে বিপক্ষ দলকে পরাজিত করে ক্রমশ বিজয়ের পথ পরিষ্কার করেছে ভারত। এর মধ্যে বলবীর সিং-কে নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের নেক নজরে আসতে পারেননি তিনি। অথচ আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে টানটান ম্যাচে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন একেবারেই। ফলে তাঁকে বাদ দেওয়ার কথা উঠলেও প্রতিবাদ করেছিলেন ইংল্যান্ডে খেলা দেখতে যাওয়া ভারতীয়রা। তার সঙ্গে লন্ডন-প্রবাসী ভারতীয়রাও ছিলেন। সবার মনের মধ্যে যে স্বাধীনতার উষ্ণ রক্ত, তারই প্রতিনিধিত্ব করছিল বলবীর সিং সহ সম্পূর্ণ দলটি। আর এভাবেই একটা একটা করে বাধা টপকে ক্রমশ এগিয়ে এল ফাইনালের দিন।
ভাগ্যও যেন এক অদ্ভুত নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে বসেছিল অলিম্পিককে ঘিরে। আর তাই ফাইনাল ম্যাচের দিনেই মুখোমুখি ভারত এবং ইংল্যান্ড। ঔপনিবেশিকতার সমস্ত দম্ভ চুরমার করে ইংল্যান্ডের বুকে বেজে উঠল ‘ভারত বিধাতা’। সবাই মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখল অশোকচক্র সহ পতাকা উড়ছে নির্ভয়ে। এর আগে লালকেল্লায় প্রথমবার স্বাধীন ভারতের পতাকা উঠেছে। সেদিন দেশের অনেক জায়গাতেই মানুষ জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতা দিবস উৎসবের মেজাজ তখনও ভারতীয়রা পাননি। এবং এরপর এতদিনের পরাধীনতার জবাব ভারতীয় দল দিয়েছিল গুনে গুনে। ইংল্যান্ডের জালে ৪ বার বল জড়িয়ে গেলেও ভারতের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর।
ভারতে যখন ফিরে আসে বিজয়ী দল, তখন সবাই তাকিয়ে দেখছেন প্রথম স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন। আর তার সঙ্গেই মিলেমিশে গিয়েছিল বলবীর সিং-দের ব্রিটেন জয়। কিংবদন্তি এই হকি খেলোয়াড় তাঁর আত্মজীবনীতেও এই ঘটনার কথা লিখে গিয়েছেন। আজ আর দলের কেউই জীবিত নেই। বলবীর সিং মারা গিয়েছেন মাত্র কয়েক মাস আগে। কিন্তু এইসব কাহিনি থেকে গিয়েছে। আর আগামী দিনেও মানুষ মনে রাখবেন খেলার মাঠের হিসাব কষার কাহিনি।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান, বিস্মৃতির অতলে নীলিমা ঘোষ