আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি ছিলই। প্রতিশ্রুতি আরো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মনির্ভর ভারতবর্ষ গড়ে তোলারও। কিন্তু প্রতিশ্রুতির ঢক্কানিনাদই যে এই দেশে সার, তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল ঢাকঢোল পিটিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের চালু করা পোর্টালের বাস্তব ছবিটা সামনে আসতেই। গত ১১ জুলাই কেন্দ্রের চালু করা আত্মনির্ভর স্কিলড্ এমপ্লয়ি এমপ্লয়ার ম্যাপিং পোর্টাল (এএসইইএম)-এ চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন ৬৯ লক্ষেরও বেশি কর্মপ্রার্থী। কিন্তু এএসইইএম-এর পোর্টাল থেকে সংগৃহীত কেন্দ্রের কারিগরি মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এই পোর্টালের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৭ হাজার ৭০০ জন!
দেশের চাকরি ক্ষেত্রে বেকারত্বের সমস্যা কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই ঘটনা থেকেই সেই ছবিটা পরিষ্কার বোঝা যায়। বর্তমানে শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য দেশের সরকার করোনা অতিমারীকে দায়ী করলেও, তার আগে থেকেই অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে অশনি সংকেতের আভাস পাওয়াই যাচ্ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেই দুঃসময় আরও তরান্বিত হয়েছে সে কথা বলাই যায়। ইতিমধ্যেই করোনার তাণ্ডবে কর্মহীন হয়েছেন বহু মানুষ। এই পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্যই ঘটা করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যদিও এর পিছনে চিন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং তার দরুণ দেশে চিনা দ্রব্যের বিকল্প প্রস্তুত করার মতো একটি সুস্পষ্ট প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা গিয়েছিল অবশ্যই। দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্য এই ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজনও ছিল বলে মনে করেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। এই আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল এই ‘এএসইইএম’। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখা গেল এটিকেও।
কারিগরি মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী হত ১৪ থেকে ২১ আগস্টের মধ্যে এই পোর্টালে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন প্রায় সাত লক্ষ মানুষ। কিন্তু এদের মধ্যে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৬৯১ জন। সম্পূর্ণ তথ্যের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে, যে ৬৯ লক্ষ কর্মপ্রার্থী নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে চাকরি পেয়ে কাজে যোগ দিতে পেরেছেন মাত্র ৭ হাজার ৭০০ জন।
মূলত লকডাউনে কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের পুনরায় কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যেই এই পোর্টালটি খোলা হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে খবর পাওয়া গেলেও, কেন্দ্রের তরফে জানানো হয় পোর্টালটি শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যেই কাজ করবে না। বরং সার্বিক ভাবে কর্মহীনতার সমস্যা মেটাতেই এটি আনা হয়েছে বলে জানানো হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই পোর্টালের মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে দর্জি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ফিল্ড টেকনিশিয়ান, সেলাই মেশিন চালানোর কর্মী, ক্যুরিয়র সার্ভিসের ডেলিভারির জন্য কর্মী, নার্স, হিসেবরক্ষক, সাফাই কর্মী এবং বিপণনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী।
আরও পড়ুন
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর বেসরকারিকরণ; অর্থনীতি কি দিশাহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশই?
লকডাউনের কারণে হরিয়ানা, কর্ণাটক, দিল্লি, তেলঙ্গানা এবং তামিলনাড়ু থেকে প্রচুর শ্রমিক কর্মহীন হয়ে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে এসেছেন। তাই বর্তমানে একদিকে যেমন শ্রমিকদের অভাব বেড়েছে ওইসব রাজ্যগুলিতে, অন্যদিকে তেমনই নিজের রাজ্যে ফিরে আসার পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কাজের চাহিদাও। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের কর্মসংস্থানের মাত্রা বেড়েছে অতি সামান্যই।
চাতক পাখির মতো এই প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। সরকারি তথ্যের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে এখানে বিপুল পরিমাণ কাজের খোঁজ-খবর করা হয়েছে স্বাস্থ্য পরিসেবা, ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, খুচরা বিপণন এবং নির্মাণ ক্ষেত্রের থেকে। এছাড়াও বিশেষভাবে লক্ষ করা গিয়েছে এই কর্মপ্রার্থীদের তালিকাতে মেয়েদের অত্যন্ত কম নাম নথিভুক্তকরণ।
আরও পড়ুন
টানা দু’সপ্তাহ ধরে দেশের গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে বেকারত্বের হার
কিন্তু কথা হচ্ছে, যেভাবে বারবার নিজের পায়ে দেশকে দাঁড় করানোর কথা বলছে কেন্দ্র, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো প্রকল্প এনে ব্যবসার পরিবেশকে আরও উন্নত করে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, আর্থিকভাবে শক্তিশালী করে তোলার কথা বলা হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রকেও, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একের পর এক আর্থিক নীতির বিপর্যয় মনে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য যে, সরকার আসলেই কতটা সদর্থক এইসব প্রকল্পের রূপায়ণ নিয়ে? শিলা উদঘাটন কিংবা কাগজে-কলমে প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করে যে আসলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, দরকার বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তার সঠিক প্রক্ষেপণ, এই সত্য কিন্তু আজ চোখের সামনে। দেশের সরকারের দিকে প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে করোনা এবং বেহাল অর্থনীতির মতো ভয়াবহ দু’টি ভাইরাসে জর্জরিত যুব সম্প্রদায়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর আশা যদি শেষমেষ নিরাশায় বদলে যায়, তবে এই লক্ষ লক্ষ দীর্ঘশ্বাসের দায় কে নেবে?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor