Cannes-এর দরজা ঠেলে: এক সন্ধের জারি-‘জুরি’ ও ৭৫ ঘা চাবুকের ছায়া

৭৫তম কান চলচিত্র উৎসবের প্রথম স্ক্রিনিং শেষ হয়েছে সবেমাত্র। ‘সালে বুনুয়েল’ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে, প্যালে দে ফেস্টিভালের তিনতলার স্বনামধন্য প্রেস ক্যাফের চেয়ারে হেলান দিতেই খেয়াল হল, আর ঘণ্টা দেড়েক সময় হাতে। তারপরই সিএফএফ-এর প্রথম প্রেস কনফারেন্স। দিস্তে বোঝাই নোটে মাথা ভার-ভার অবস্থা, তার ওপর একবার লাইন পড়ে গেলে কোথায় যে বসতে পারা যাবে, তার ইয়ত্তা নেই।

প্রেস ক্যাফে থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে খানিকটা এগোলেই ইনফরমেশন ডেস্ক। তার ঠিক গায়েই প্রেস কনফারেন্স রুম। ভালোই লাইন। অনেকেই উদ্বিগ্ন। আমিও। প্রায় মিনিট কুড়ির অপেক্ষা। প্রথমে বিরাট বিরাট ক্যামেরা/ভিডিও ক্যামেরা সমেত অডিও-ভিজুয়াল সাংবাদিকদের পালা। তারপর আমরা। কপাল ভালো! মোটামুটি মাঝামাঝি একটা জায়গা পাওয়া গেছে। 

কনফারেন্স শুরু হওয়ার প্রথম খানিকক্ষণ অবিশ্বাস্য ঠেকে সব। স্টেজ আলো করে পরপর জুরি মেম্বাররা বসে আছেন। একেবারে বাঁ-হাতে সঞ্চালক। এরপর একে একে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের জেফ নিকোলাস, ইতালির জাসমিন ত্রিংকা, নরওয়ের জোয়াচিম ট্রিয়ার, আমাদের দীপিকা পাড়ুকোন, সভার মধ্যমণি ও এবারের জুরি প্রেসিডেন্ট ফরাসি নক্ষত্র ভঁন্সন্টঁ লনদঁ, রেবেকা হল(ইউ-কে), লাডজ লাই(ফরাসি), সুইডেনের নুউমি রাপাশ, এবং সবশেষে স্টেজের ডান পাশ আলো করে ইরানের চলচ্চিত্র জগতের সমকালীন মধ্যমণি আসগার ফারহাদি! 

হালকা চালে শুরু হওয়া সাংবাদিক সম্মেলন ক্রমেই গুরুগম্ভীর প্রশ্নের দিকে এগোয়। অস্কার নমিনি জোয়াচিম জানান, কীভাবে তাঁর প্রথম কান উৎসবে যোগদানের সঙ্গে তাঁর ঠাকুরদার স্মৃতি জড়িয়ে। অন্যদিকে লাডজ ও রেবেকার মুখে বারবারই উঠে আসে, এই ফেস্টিভালে জুরি হিসাবে যোগ দিতে পারা আদপেই এক স্বপ্নসার্থকতার নিদর্শন। অন্যদিকে ভঁন্সন্টঁ ও দীপিকার কথায় জুরি হিসাবে তাদের এবং আজকের পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে সিনেমার দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ ঘোরাফেরা করে। ভঁন্সন্টঁ বলেন, ‘আমি সিনেমা বিচার করার কাজটা পছন্দ করি না। আমি ছবিগুলো দেখার চেষ্টা করব, ওদের ভালোবাসব, ওদেরকে আমার সঙ্গে খেলা করতে দেব, আর তারপর দেখব কীভাবে তারা আমার ভাবনার সঙ্গে এবং আমার মনে যা আছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে।...’ 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ‘ফর দ্য সেক অব পিস’— প্রথম স্ক্রিনিং, প্রথম সবকিছু

তেমনই এক প্রশ্নে দীপিকার জবাবও খোলামেলা। ‘কানের মঞ্চে বিচারকের ভূমিকাপালন অবশ্যই একটা বড়ো দায়িত্ব। তবে এই দায়িত্ব যেন কোনোভাবেই বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়, সেই প্রতিশ্রুতি আমরা প্রত্যেকেই নিয়েছি। দায়িত্বের বোঝা সরিয়ে, সিনেমাগুলো উপভোগ করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা প্রত্যেকেই সৃষ্টিশীল শিল্পী। আমার মনে হয়, কোনো চলচ্চিত্রকে বিচার করা বা তার সমালোচনা করা আমাদের যোগ্যতা বা সামর্থ্যের বাইরে।’ 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সোমবারের দুপুর, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও সত্যজিৎ-ছায়া

শেষ পর্যায়ে এসে ড্যানিশ এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তাঁর ওপর ওঠা প্লেজিয়ারিজমের (অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাওয়া ‘আ হিরো’ ছবিটি সম্বন্ধে ফারহাদির ছাত্রের দাবি) বিষয়ে আসগার ফারহাদির প্রলম্বিত উত্তর কনফারেন্সের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। ইরানি পরিচালক জানান—

‘আমি আগে কখনও এই বিষয়ে সরাসরি কথা বলিনি। আপনি যা যা বললেন তা মূলত খবরের কাগজগুলোতেই বেরিয়েছিল। তথ্যগুলো ভুল, যা পরে ঠিক করে নেওয়া হয়। ডকুমেন্টারিটা (ওঁর ছাত্রের তৈরি) আমি একটা ওয়ার্কশপে দেখি। সেটা নিয়ে ছাত্রের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছিল। ‘আ হিরো’ ছবিটা অনেক পরে তৈরি হয়। ছবিতে যা আছে, তা অনেকটাই আলাদা। কাজেই এটাকে প্লেজিয়ারিজম বলা চলে না। ওই ডকুমেন্টারি ও ‘আ হিরো’ ছায়াছবি এ দুটোই বছর দুই আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একটা ঘটনা প্রেসের হাত ধরে জনমানসের নজরে এলে, অনেকেই তা নিয়ে ছবি বানাতে পারেন। ‘আ হিরো’ ঘটনাটার এক ধরনের ইন্টারপ্রিটেশান মাত্র। ডকুমেন্টারি ছবিটা একেবারেই আলাদা। কাজেই এই দাবিগুলো মিথ্যা এবং আমাদের দেশের ধর্মীয় ব্যবস্থা এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছে।’ 

বস্তুত, সেই আরোপের বিরুদ্ধে ফারহাদি ছাত্রের উপর ডিফেমেশনের মামলা করেছিলেন। সে মামলার ফল ছাত্রের বিরুদ্ধে গেলে ইসলামিক ইরানের নিয়ম অনুযায়ী তার কপালে ৭৫ ঘা চাবুক এবং ২ বছর অবধি কারাবাসের খাঁড়া ঝুলছে। খবরে অবশ্য জানা যায় যে, সে-সমস্যার অনেকটা মিটেছে। তবে ছাত্রটির কী পরিণতি হতে পারে, তা জেনেও তিনি কেন ডিফেমেশন মামলা করতে দ্বিধা করেননি, সে-বিষয়ে একটি কথাও বলেননি বিশ্বখ্যাত ইরানি পরিচালক। 

শেষ হয়েছে ৭৫তম কান চলচিত্র উৎসবের প্রধান জুরি কনফারেন্স। তারকারা ধীর পদক্ষেপে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেই স্টেজের বাঁহাতের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বহু তপস্যাতেও এ-উৎসবে আর এঁদের দেখা মিলবে না। কারণ রেড কার্পেট অনুষ্ঠানের মধ্যাংশে ফেস্টিভালের নিজস্ব সাংবাদিক এবং তারকাদের অফিশিয়াল সাংবাদিক ছাড়া মাছি গলারও উপায় নেই। লুমিয়ের প্রেক্ষাগৃহেও ক্যামেরা ও মোবাইল ব্যবহার ব্রাত্য। অনেক সাংবাদিক সহকর্মী অবশ্য ক্যামেরা বাগিয়ে ছুটেছেন দরজা লক্ষ্য করে, কিন্তু আমার এখন সিট ছেড়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। এরপর ফরেস্ট উইটেকারের প্রেস কনফারেন্স, এ-ঘরেই, মনে-মনে ওঁর জন্য কিছু প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। আমি দু-নম্বর সারির মাঝামাঝি একটা চেয়ার তাক করে অপেক্ষায়!

Powered by Froala Editor

More From Author See More