প্রত্যেক নক্ষত্রের চারিদিকেই নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি বৃত্তাকার অঞ্চল থাকে, যেখানকার উষ্ণতা প্রাণের বিকাশের জন্য উপযুক্ত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিশেষ অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘হ্যাবিটেবল জোন’ (Habitable Zone)। ঠিক সেভাবেই সূর্যের হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থান পৃথিবীর (Earth)। আর সেই কারণেই বাসযোগ্য আমাদের গ্রহ। তবে পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে তুলতে বৃহস্পতির ভূমিকাও কম নয়। এমনকি পৃথিবীর জলবায়ুও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বৃহস্পতির (Jupiter) মাধ্যমে।
এবার এমনই আশ্চর্যকর তথ্য উঠে এল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়। সম্প্রতি ‘অ্যাস্ট্রোনমিকাল’ বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গল কিংবা শুক্রকে বাদ দিয়ে কেন বৃহস্পতিকেই পৃথিবীর রক্ষাকবচ বলছেন গবেষকরা?
সৌরজগতের সবচেয়ে বাইরের অংশে ‘বসবাস’ করে বিভিন্ন গ্রহাণু ও ধূমকেতু। পৃথিবী বা অন্যান্য গ্রহদের মতো তারাও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে উপবৃত্তাকার পথে। তবে সেই গতিপথের উৎকেন্দ্রতা পৃথিবীর থেকে বহুগুণ বেশি। ফলে, পৃথিবীর কক্ষপথের উপর উপরিপাতিত হয় তাদের কক্ষপথও। থেকে যায় সংঘর্ষের আশঙ্কা। আজ থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে এমনই এক গ্রহাণুর ধাক্কায় পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল ডাইনোসরদের অস্তিত্ব। তবে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহাণুর সংঘর্ষের সম্ভাবনা তৈরি হয় প্রতিনিয়তই। বৃহস্পতির উপস্থিতিই নীল গ্রহকে রক্ষা করে সেই সংঘর্ষ থেকে।
সৌরজগতের সবচেয়ে বড়ো গ্রহ বৃহস্পতির ভর পৃথিবীর প্রায় ৩১৮ গুণ। এই ব্যাপক পরিমাণ ভরের কারণে বৃহস্পতির মহাকর্ষ বলও পৃথিবীর তুলনায় বহুগুণ বেশি। ফলে অধিকাংশ গ্রহাণু এবং ধূমকেতু বৃহস্পতির আকর্ষণে তাদের গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়। সরাসরি আঘাত হানতে পারে না পৃথিবীতে।
এখানেই শেষ নয়, পৃথিবীর অবস্থানের ক্ষেত্রেও বড়ো ভূমিকা রয়েছে বৃহস্পতির। কেবলমাত্র সূর্যের আকর্ষণই নির্দিষ্ট কক্ষপথে বেঁধে রাখেনি পৃথিবীকে। একইসঙ্গে, বৃহস্পতির আকর্ষণ বলও প্রভাবিত করে পৃথিবীর কক্ষপথকে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে, পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির গড় দূরত্ব বজায় রেখে কক্ষপথের উৎকেন্দ্রতা সামান্য বৃদ্ধি করলে, পরিবর্তিত হয় পৃথিবীর কক্ষপথ এবং অক্ষের কৌণিক অবস্থান। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও হ্রাস বা বৃদ্ধি পেতে পারে বৃহস্পতির কক্ষপথের পরিবর্তনে।
শুধু তাত্ত্বিকভাবেই নয়, ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ঘটেছে বলেই দাবি গবেষকদের। সামান্য হলেও পৃথিবীকে সূর্য থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে বৃহস্পতি। তাতে পৃথিবীর জলবায়ু হয়ে উঠেছে প্রাণের বসবাসযোগ্য। আগামী কয়েক কোটি বছরের মধ্যে ফের লক্ষ্য করা যেতে পারে এই ঘটনা, এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা। অর্থাৎ, বিশ্ব-উষ্ণায়নে পৃথিবী প্রাণশূন্য হয়ে পড়লেও, ফের বৃহস্পতির সৌজন্যে নতুন ‘হ্যাবিটেবল জোন’ খুঁজে নিতে সক্ষম পৃথিবী। অবশ্য সেই পরিবর্তন দেখার জন্য মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছেই…
Powered by Froala Editor