তখন ১৬ বছর বয়স তাঁর। হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ হতে তখন বছর খানেক বাকি। তারপর ইউনিভার্সিটি। কিন্তু হাইস্কুলের গণ্ডি পেরতে গেলেও তাঁকে অঙ্কের ক্লাস করতে হবে তাঁকে। এদিকে অঙ্ক তাঁর একেবারেই ‘না পসন্দ’। বরং, তাঁর স্বপ্ন একদিন কবিতা লিখে বিখ্যাত হবেন তিনি। হ্যাঁ, কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই স্কুল ছেড়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত অঙ্কের কাছেই ফিরতে হবে— এই যেন ভবিতব্য ছিল তাঁর।
কথা হচ্ছে জুন হু-কে (June Huh) নিয়ে। আজ সকালেই চলতি বছরের ফিল্ডস মেডেল (Fields Medal) প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ করেছে ফিনল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ম্যাথামেটিকস। আর চলতি বছরের ৪ বিজয়ীদের সেই তালিকাতেই রয়েছে তাঁর নাম। একদিন অঙ্ক থেকে পরিত্রাণের জন্য যিনি স্কুল ছেড়েছিলেন, এবার তাঁর হাতেই উঠল গণিতের ‘নোবেল’! পাশাপাশি প্রথম কোরিয়ান গণিতবিদ হিসাবে ফিল্ডস পদক জিতে এক নতুন ইতিহাসও তৈরি করলেন জুন হু। আক্ষরিক অর্থেই এ যেন এক রূপকথা…
বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসাবে ধরে নেওয়া হয় নোবেল পুরস্কারকে। তবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি এবং সাহিত্য— এই পাঁচটি বিষয়কেই নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন স্যার অ্যালফ্রেড নোবেল। পরবর্তীকালে এই তালিকায় অর্থনীতি যুক্ত হলেও, ব্রাত্য রয়ে গেছে গণিত। গণিতের ক্ষেত্রে আজও সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসাবে ধরে নেওয়া হয় ফিল্ডস মেডেলকেই। তবে এই খেতাব প্রদান করা হয় কেবলমাত্র অনূর্ধ্ব চল্লিশের গণিতবিদদের। হু ছাড়াও চলতি বছরে এই সম্মাননা পেলেন জেমস মেইনার্ড, হুগো কপিন, ম্যারিনা ভায়াযোওস্কা।
যাই হোক, ফেরা যাক জুন হু-র গল্পে। কবিতা লেখা শুধু স্বপ্নই ছিল না ফিল্ডসজয়ী গণিতবিদের। সেই স্বপ্নকে রীতিমতো বাস্তবায়িতও করেছিলেন জুন। স্কুল ছাড়ার পর দীর্ঘ দু-বছর মজেছিলেন সাহিত্যচর্চায়। তাঁর কলমে সে-সময় জন্ম নিয়েছে অসংখ্য কবিতা। কিছু দীর্ঘ কবিতাও। যা ঋদ্ধ করতে পারে যে-কোনো সাহিত্যপ্রেমীকেই। কিন্তু কবিতার জগৎ ছেড়ে আবার কীভাবে গণিতের দুনিয়ায় ফিরে এলেন হু?
আরও পড়ুন
গণিতের ‘ভুল’-এর জন্যই মাংস ছেড়ে পালং বেছেছিল পপ-আই!
এর নেপথ্যে রয়েছেন আরও এক ফিল্ডসজয়ী গণিতবিদ। জাপানের হেইসুকি হিরোনাকা। যিনি ১৯৭০-এ ফিল্ডস পদক পেয়েছিলেন অ্যালজেবরিক জিওমেট্রির কাজের জন্য। বলতে গেলে হেইসুকির বক্তৃতা শুনেই নতুন করে গণিত-এর প্রেমে পড়েছিলেন হু। অবশ্য, এক্ষেত্রে তাঁর বাবার গুরুত্বও কম নয়। পরিবারের চাপেই আবার স্কুলের গণ্ডিতে পা রেখেছিলেন হু। তারপর কলেজ।
আরও পড়ুন
১৯৫৯ সালের গণিত-ধাঁধা সমাধান করে পুরস্কার ভারতীয় বংশোদ্ভূতের
সেটা ২০০২ সালের কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার সেওল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা ও মহাকাশবিদ্যা বিভাগের ছাত্র তখন হু। তবে মন বসত না ক্লাসে। লক্ষ্যহীনভাবেই তিনি ঘুরে বেড়াতেন অন্যান্য বিভাগে। হামেশাই তাঁকে দেখা যেত সাহিত্যের ক্লাসে। ঠিক তেমনভাবেই অধ্যাপক হেইসুকি হিরোনাকার একটি ক্লাসে ঢুকে পড়া হু-এর। হিরোনাকার ব্যক্তিত্ব, তাঁর বাচনভঙ্গি তো বটেই, তাঁর গবেষণার বিষয় অ্যালজেবরিক জিওমেট্রি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে হু-কে। অদূর ভবিষ্যতে হিরোনাকাই হয়ে ওঠেন হু-এর মেন্টর। গণিত শিক্ষক-ও।
আরও পড়ুন
ছেলেবেলার স্বপ্নপূরণ করতে এসে অলিম্পিকে সোনা গণিতের অধ্যাপকের
স্নাতকতা শেষ করতে দীর্ঘ ৬ বছর সময় নিয়েছিলেন হু। তবে তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সেওল থেকেই আমেরিকা-পাড়ি। সেখানেই গণিতে ডক্টরেট মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১০-এর দশকে মেট্রোয়েড এবং ক্রোমাটিক পলিনোমিয়াল নিয়ে তাঁর গবেষণা প্রশংসিত হয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। তবে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান এনে দিল কম্বিনেটরিক্স-এর উপর তাঁর সাম্প্রতিকতম কাজ। যা শুধু গণিতই নয়, বরং পদার্থবিদ্যাকেও আলোকিত করবে নানান আঙ্গিকে। ২০২১ সালে তাঁর এই কাজের জন্যই সামসাং হো-আম পুরস্কার পেয়েছিলেন হু। এবার প্রথম কোরিয়ান গণিতবিদ হিসাবে বসলেন বিশ্বসেরার আসনে…
Powered by Froala Editor