আর মাত্র কদিন পরেই বড়দিন। এর মধ্যেই এল সুখবর। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্নাতকস্তরের শংসাপত্র দেওয়া হবে কলেজ থেকে। যাক, পড়াশোনার একটা ধাপ শেষ। এবার স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পারবেন প্রাণীবিজ্ঞানী বাবা হ্যান্স উইলহেম কোপকের সঙ্গে। পক্ষীবিশারদ মা মারিয়ারও প্রবল উৎসাহ মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। এবার শুধু পেরুর (Peru) রাজধানী লিমা থেকে পুকালপায় ফেরার অপেক্ষায়। ওখানকার আমাজনের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলেই আপাতত কাজ করছেন হ্যান্স। ২৪ ডিসেম্বর সকালে বিমানে চাপলেন জুলিয়ান কোপকে (Juliane Koepcke) ও তাঁর মা। কিন্তু ওই এক ঘণ্টার যাত্রাপথে যে কী বিভীষিকা লুকিয়ে আছে, তা কল্পনা করতে পারেননি কিশোরী জুলিয়ান।
লানসা ফ্লাইট-৫০৮ বিমানে ওঠার বিষয়টা নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল হ্যান্সের। এই বিমানসংস্থার পরিষেবা বেশ খারাপ। কিন্তু সবারই ক্রিসমাসের আগে বাড়ি ফেরার তাড়া। অন্য বিমানে নতুন করে টিকিট পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ফলে ফ্লাইট-৫০৮ বিমানের দুটি টিকিট আর বাতিল হল না। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কিছু দূর ওঠার পরেই ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টির মুখোমুখি হয় বিমানটি। হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ে বিমানের ইঞ্জিনে। মৃত্যু নিশ্চিত। ৯০ জন আতঙ্কিত যাত্রী নিয়ে ক্রমশ নেমে যেতে থাকে ১০ হাজার ফুট নিচে মাটির দিকে। প্রবল চিৎকার আর মৃত্যুভয়ের মধ্যে জ্ঞান হারান জুলিয়ান।
সংজ্ঞা ফেরার কথা ছিল না। তাঁকে বাঁচিয়ে দিল সিটবেল্ট। বিমানটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও ঘটনাচক্রে সিটবেল্টটি অক্ষত ছিল। গাছপালার মধ্যে বেঁধে গিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে জুলিয়ানকে। কিন্তু এ তিনি কোথায় এসে পড়লেন? চারিদিকে গহন অরণ্য। ঝাপসা বোধবুদ্ধিতেই বুঝলেন এ নিশ্চয়ই আমাজনের কোনো একটি অঞ্চল। আর বাকিরা? তাঁর মা? সবাই কোথায়? উঠে খোঁজার মতো শক্তিও নেই তাঁর। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, শরীরের একাধিক অংশ ভেঙে গেছে তাঁর। মাথার পিছনে প্রবল আঘাত, হাঁটুতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে গাছের ডাল। কাঁধের কাছেও প্রচণ্ড ব্যথা। সম্ভবত সেখানেও কোনো হাড় ভেঙেছে। ফের জ্ঞান হারালেন জুলিয়ান।
প্রায় একদিন ওই অবস্থায় কাটার পরে একটু সুস্থ বোধ করেন। তখনও পরিষ্কার করে বুঝতে পারেননি যে তিনি বাদে আর কেউ সেদিন বাঁচেনি। এমনকি তাঁর মা মারিয়াও নয়। বেশ খানিকক্ষণ উদভ্রান্তের মতো খুঁজলেন প্রাণের অস্তিত্ব। অত উঁচু থেকে ভেঙে পড়ার সময় কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, তার ইয়ত্তা কী? এবার মৃত্যুভয় ঢুকল তাঁর মনে। আমাজনের অরণ্যে তিনি একা। কোথায় যাবেন, কী খাবেন জানেন না। শরীর ক্ষতবিক্ষত। চশমার অভাবে কিছুই চোখে দেখতে পারছেন না। পদে-পদে হিংস্র প্রাণীদের ভয়। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট পথ বেছে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন জুলিয়ান। প্রায় তিন দিন হাঁটার পর চোখে পড়ল দুয়েকজন যাত্রীর মৃতদেহ আর বিমানের ধ্বংসাবশেষ। খুঁজে পেলেন ব্যাগভর্তি ক্যান্ডি আর কিছুটা গ্যাসোলিন। বাকি কটা দিন ওই ক্যান্ডি খেয়েই জীবনধারণ করেন তিনি। এদিকে ক্রমশ পচন ধরছে ক্ষতে। বাসা বেঁধেছে পোকারা। যন্ত্রণা উপেক্ষা করে গ্যাসোলিন ঢেলে দিলেন ক্ষতস্থানে। আপাতত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল সেপটিক হওয়ার ভয় থেকে।
আরও পড়ুন
মেক্সিকোর অরণ্যে এক ‘হারানো’ নগর, আজও ঘেরা রহস্যের পর্দায়
লানসা ফ্লাইট-৫০৮ বিমানের সন্ধানে কিন্তু ইতিমধ্যে উদ্ধারকার্য শুরু হয়েছে। জুলিয়ানের কানেও আসে হেলিকপ্টারের শব্দ। কিন্তু ঘন অরণ্যের মধ্যে কিছুই দেখা যায় না। বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় উদ্ধারকারী দল। ফলে ফের একাই শুরু হল তাঁর নিদ্রাহীন পথচলা। আরো বেশ কয়েকদিন হাঁটার পর চোখে পড়ল একটা ছোটো নদী। মনে পড়ে গেল বাবার থেকে পাওয়া শিক্ষা। নদীর ধার ধরেই থাকে লোকালয়। আরো বেশ কয়েকদিন পথ চলার পর পাওয়া গেল একটি ছোট্টো কুঁড়ে ঘর। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত জুলিয়ানের সব শক্তি যেন শেষ হয়ে গেল সেখানে এসে। চোখে নেমে এল তন্দ্রা। অবশেষে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এগারো দিন পরে মানুষের দেখা পেলেন। ঘুম থেকে উঠে মনে হয় ‘দেবদূত’-রা দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সামনে। পরদিন জুলিয়ানকে স্থানান্তরিত করা হয় পুকালপায়।
আরও পড়ুন
তেল উত্তোলনের আড়ালে অরণ্যধ্বংসই নিয়তি? অপেক্ষায় ইকুয়েডরবাসী
জীবন ছন্দে ফিরতে কিছুটা সময় লাগে। পরে জার্মানি থেকে জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছেন ডক্টরেট সম্মান। বাদুড়দের নিয়ে গবেষণায় নাম ছড়িয়েছে দেশ-বিদেশে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো তাঁকে বারবার তাড়া করে বেরোয় ওই এগারোটা অভিশপ্ত দিন। যে দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন মাকে। প্রাণ গেছে আরো অসংখ্য মানুষের। শুধু তিনিই একা জীবিত। পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র হয়েছে, বই লেখা হয়েছে। আর সেখানেও বারবার একটা প্রশ্নই রেখেছেন জুলিয়ান, “কেন আমিই বেঁচে গেলাম?” অরণ্যে মৃত মানুষরা যেন সব সময় ঘিরে রাখত তাঁর স্মৃতিকে। হানা দিত অবচেতনে। শুধু একটাই প্রশ্ন, ‘কেন আমিই?’ সেটাই তাঁকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে আজীবন, এখনও বহন করতে হচ্ছে সেই দুঃসহ এগারো দিনের স্মৃতি।
Powered by Froala Editor