এ জমিতে লড়াই কঠিন - বিজেপিকে বোঝাচ্ছে যাদবপুর

‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী, তা বল?’

গাইছেন তিনি। গাইতে গাইতে হাঁটছেন ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপর দিয়ে। আশেপাশের আরও অনেক তরুণ-তরুণী গলা মেলাচ্ছে তাঁর সঙ্গে। কিংবা তিনিই মিলিয়েছেন বাকিদের সুরে সুর। এখানে বিভেদ নেই। বিভেদ করতে নেই। তিনি হাসছেন। ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা’ – গাওয়ার সময় ঝিকিয়ে উঠছে চোখ। এই চোখই একদিন তিনি মেলেছিলেন স্বপ্ন দেখবেন বলে। ‘তোমাদের কাছে এসে দু’হাত’ পেতেছিলেন তিনি। এই ‘তোমাদের’ কারা? এই মিছিলে কি তাদেরই খুঁজে পেলেন মৌসুমী ভৌমিক?

যাদবপুরের ঘটনার পর কেটে গেছে তিনদিন। মিছিলের পরও, হ্যাঁ, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা হতে তো চললই। কমবেশি সকলেই জেনে গেছেন ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও জানিয়েছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ, দু’একজনের বিক্ষিপ্ত আক্রমণ, মন্ত্রী ও তাঁর দেহরক্ষীদের আক্রমণ, উপাচার্যের প্রতি মন্ত্রীর উদ্ধত ব্যবহার, প্রায় ৫ ঘণ্টা মন্ত্রীকে আটকে রাখা ও শেষে রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ, এবিভিপি-র নারকীয় তাণ্ডব ও ইউনিয়ন রুম ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, তড়িৎদার মতো বৃদ্ধ দোকানিকে আক্রমণ, দোকান ভেঙে দেওয়া– ঘটনার কমতি নেই। এসবের মধ্যে থেকে, নাগরিক সমাজে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে এসেছে বারবার – মন্ত্রীর উদ্ধত আচরণ ও আক্রমণ কতটা সমর্থনযোগ্য? ছাত্রছাত্রীরাও কি খানিক সংযত হতে পারতেন না? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যাবেন, এটা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার, তাঁকে আটকানো হল কেন—এই প্রশ্নও উঠছে। এরই সঙ্গে জুড়েছে দিলীপ ঘোষের মধুবচন। যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা সমাজবিরোধী, তাদের ওপর সার্জিকাল স্ট্রাইক হওয়া উচিত। এমনকি যাদবপুরের ছাত্রীদের সঙ্গে ঘুরিয়ে দেহপসারিনীদের তুলনাও টেনেছেন তিনি। সব মিলিয়ে, হাজারো কথায়, পাল্টা কথায়, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাক্রম জটিলতর হয়েছে।

গণতন্ত্রের প্রশ্ন উঠতেই ব্যাপারটা খানিক জটিল হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক দেশে কতখানি ঠিক গণতন্ত্র, তা বোঝা মুশকিল। এই যেমন ধরা যাক, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ হল। তারপর, গোটা কাশ্মীর ভারতীয় সেনার আওতায় চলে গেল। কেউ ঢুকতে-বেরোতে পারছেন না, ফারুক আবদুল্লার মতো প্রবীণ নেতা প্রথমে গৃহবন্দি, পরে গ্রেপ্তার। দেশের নির্বাচিত সাংসদরা (মায় রাহুল গান্ধীও) কাশ্মীরে ঢুকতে পারছেন না। সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে শর্তসাপেক্ষে কাশ্মীরে প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে হচ্ছে। কাশ্মীরের হাইকোর্টের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টে। গণতান্ত্রিক ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ কাশ্মীরের এহেন গণতান্ত্রিক ছবি দেখে সাধারণ নাগরিকরা গণতন্ত্রের কোন পাঠ নিচ্ছেন, তা বোঝা কঠিন। এবারে, যাদবপুরের ঘটনায় এই বিজেপিই প্রশ্ন তুলছে বাবুল সুপ্রিয়ের গণতান্ত্রিক অধিকারের।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিগত কয়েক দশক ধরেই প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। এই দশকে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের ছাত্র রাজনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। সেখানে নানা ধারার রাজনীতি চলে। শাসকপক্ষ বারবার এখানে এসে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ-প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। বাম আমলে সিপিএম, কলরবের সময় তৃণমূল – কোনো পক্ষই বাদ যায়নি। এখন বিজেপি যে বিশেষ রাজনীতিটি নিয়ে খেলছে গোটা দেশে, সেই রাজনীতিকে স্বাভাবিক নিয়মেই বিরোধিতা করছে যাদবপুরের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী। বাবুল সুপ্রিয় ক্যাম্পাসে আসবেন জেনে সেদিন তাই প্রতিবাদের চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের তরফে বাড়তি কিছু ঘটেছিল কিনা, তা তর্কের বিষয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আটকে রাখাটাও কতটা উচিত, তা নিয়েও ‘গণতান্ত্রিক পরিসরে’ প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নটাই তো সাম্প্রতিক রাজনীতির ডিসকোর্সে ঘাঁটা। তাছাড়া, সেদিনের ঘটনায় বাবুল সুপ্রিয়ও ক্লিনচিট পাবেন না। যাদবপুর ক্যাম্পাসে গেটের বাইরে সেদিন শুরু থেকেই নাকি অপেক্ষা করছিলেন অস্ত্রধারী বিজেপি সমর্থকেরা। কেন করছিলেন? কথা চাইলে বাড়ানো যায়।

ছাত্রছাত্রীদের দোষত্রুটি নিয়ে এরপরেও সঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু, সেই প্রশ্ন-সমালোচনা দিয়ে সেদিন সন্ধেয় এবিভিপির তাণ্ডবকে আড়াল করা যায় না।

এরপর, শুক্রবার সন্ধেয় যে-দৃশ্য দেখল দক্ষিণ কলকাতা, তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট – যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা একা নন। তাঁদের পাশে রয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসংখ্য মানুষ। যাদবপুরের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে কী প্রভাব ফেলবে, তা পরের বিষয়। কিন্তু নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ যে সেদিনের ঘটনায় বিজেপির পক্ষে নেই, তা দেখাই যাচ্ছে।

দিলীপ ঘোষ-সহ বিজেপির নেতৃত্ব বারবার আক্রমণ করেছেন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের। এই ক্যাম্পাসে নানাভাবে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে বিজেপি। বারবার ছাত্রছাত্রীরা প্রতিরোধ করেছেন সম্মিলিতভাবে। দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এমন ব্যবহার পেয়ে দৃশ্যতই বেকায়দায় পড়েছে বিজেপি নেতৃত্ব। রাগ জন্মেছে। সেই রাগের বহিঃপ্রকাশই দিলীপ ঘোষের কথায় উঠে এসেছে বারবার। যাদবপুরে সার্জিকাল স্ট্রাইক (গণতান্ত্রিক দেশের ভিতরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইকের’ কথা বলছেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এক সাংসদ), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের চরিত্র তুলে বলা নানা কথা থেকে একটা আগ্রাসনের হুঙ্কার স্পষ্ট, স্পষ্ট রাগও। বিজেপির রণনীতি আপাতত হয়ত এটাই। রাজ্যে মেরুকরণ এভাবেই হবে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব, এই ঘটনাতেও সাধারণ মানুষের গরিষ্ঠ অংশ তাদের পক্ষেই থাকবেন বলে মনে করছেন। এনআরসি থেকে শুরু করতে নানা বিষয়েই তাঁরা খুলে খেলছেন। বিজেপির এই রণনীতি তাঁদের জন্য ঠিক না ভুল, তার উত্তর পরে মিলবে। 

কিন্তু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁত ফোটানো যে কিঞ্চিৎ কঠিন, তা আবারও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বিজেপি-নেতৃত্ব। রাজ্যের তথা দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধার মানকে অস্বীকার করাও কঠিন। ফলে, দিলীপ ঘোষের বলা কথাগুলো তাঁর দিকেই ‘বুমেরাং’ হবে কিনা, জানা নেই।

আপাতত যাদবপুরকে ঘিরে বঙ্গ-রাজনীতি আবার জমজমাট। কেননা এবারে প্রথাগত বিজেপি-তৃণমূল নয়, লড়াইটা বিজেপি বনাম বাংলার ছাত্রসমাজের একাংশের(যাদবপুরের পাশে রাজ্যের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসে দাঁড়িয়েছে)। রাজ্যে ক্ষমতায় তৃণমূল। এদিকে রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম গর্ভগৃহের লড়াইটা বিজেপির সঙ্গে। এমন ঘটনাও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে চমকপ্রদ।