সামনে ৪৪০ গজের ট্র্যাক। স্টার্টিং লাইনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন তিনি। একবার কপালেও হাত ঠেকালেন কি? তাঁর কাঁধে ৪৫ কোটি মানুষের প্রত্যাশা। অগাধ ভরসা নিয়েই সবাই তাকিয়ে রয়েছেন তাঁর দিকে। তাঁদের যোগ্য সম্মান কি এনে দিতে পারবেন তিনি? এই চিন্তা, মানসিক চাপে ঘুমও হয়নি আগের রাতে। সারারাত ছটফট করেছেন তিনি বিছানায়। গোটা দেশের দায়িত্ব রক্ষা করা তো মুখের কথা নয়! বাঁশি বেজে উঠল কয়েক মুহূর্তেই। দুশ্চিন্তাদের দূরে সরিয়ে রেখে তিনি শক্ত করে নিলেন শরীর। না, এ লড়াই তাঁকে জিততেই হবে। তারপর বন্দুকের ফায়ারিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় ছুঁড়ে দিলেন শরীরটাকে।
মিলখা সিং। তাঁর কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। আর সময়টা, ১৯৫৮ সাল। ওয়েলসের কার্ডিফে বসেছে কমনওয়েলথ গেমসের আসর। আন্তর্জাতিক সেই মঞ্চেই তিনি স্বর্ণপদক এনে দিয়েছিলেন ভারতকে। রচনা করেছিলেন এক স্বপ্নের ইতিহাস। ইতিহাসেরই সেই সোনার অধ্যায়ই যেন ফুরিয়ে গেল নিমেষে। গতকালই ৯১ বছর বয়সে চলে গেলেন ভারতের এই কিংবদন্তি দৌড়বিদ। সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়ে চণ্ডীগড়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির কারণে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ইননেসটিভ কেয়ার ইউনিটে। তবে ব্যর্থ হল চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা। এই জগত ছেড়ে যেন অন্য এক ট্র্যাকের দিকেই দৌড় লাগালেন তিনি।
১৯৪৭ সাল। এবার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবে ব্রিটেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ভারতবর্ষকে কেটে দু’ টুকরো করে দিল ঔপনিবেশিক শাসকরা। কাঁটাতারের বেড়া আলাদা করে দিল ভারত-পাকিস্তানকে। আর গোটা দেশজুড়ে জ্বলে উঠল হিংসার আগুন। যে দাঙ্গায় সবথেকে বেশি রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল বাংলা ও পাঞ্জাব। পাকিস্থানে অবস্থিত সেই পাঞ্জাবেই বড়ো হয়ে ওঠা যে তাঁর। ফলত, দাঙ্গার আগুনে ঝলসে দিল তাঁর সাজানো পরিবারকেও। ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে— তা যে মানতে পারেননি কেউ-ই। আর তার মাশুল গুনতে হল জীবন দিয়েই। মিলখা চোখের সামনে রক্তাক্ত হয়ে যেতে দেখলেন নিজের বাবাকে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে অস্ফুটে তিনি বলে উঠেছিলেন ‘ভাগ, মিলখা…’।
দৌড়টা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। প্রাণ বাঁচাতে। উঠেও পড়া গেল দিল্লিগামী ট্রেনে। কিন্তু সেখানেও চলছে দাঙ্গাকারীদের চিরুনি তল্লাশি। কোনোক্রমে মহিলাদের সিটের তলায় লুকিয়ে ভারতে এলেন তিনি। কিন্তু সবকিছুই যে পড়ে রয়েছে সীমান্তের ওপারে। এই নতুন শহরে বেঁচে থাকার মতো সম্বল? অর্থ, মাথা গোঁজার ঠাঁই— কোনোটাই যে নেই তাঁর কাছে। বয়স তখন সবে বারো বছর। কেই বা কাজ দেবে তাঁকে? ফলত, অর্থের তাগিদেই জড়িয়ে পড়লেন ছোটোখাটো অপরাধে। ক্রমশ গিলে নিতে শুরু করল অন্ধকার একটা জগত।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকে প্রথমবার কোনো ভারতীয় দম্পতি, ইতিহাস তৈরির পথে অতনু-দীপিকা
অবশ্য সেই অন্ধকার ফুড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি নিজেই। বছর খানেকের মধ্যে কাজ জুটল এক হোটেলে। রাস্তার ধারের এক রেস্তোরাঁয় বয়-এর কাজ। তারপর সেখান থেকে ভারতের সেনাবাহিনী। এক অনবরত দৌড় চলছিল শৈশব থেকেই। তবে সেনাবাহিনীর সূত্রেই তাঁর প্রবেশ ক্রীড়াজগতে। সেটা ১৯৫৬ সাল। ৪০০ জন প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে ষষ্ঠ স্থান দখল সেনাবাহিনীর ক্রস-কান্ট্রি রেসে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই, অনুশীলন ছাড়াই এমন এক সাফল্য! নজরে কাড়লেন প্রশিক্ষকের। তারপরই শুরু হল আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ। তবে নামেই আন্তর্জাতিক। যে দেশের বয়স ১০ বছর, সেখানে কতটাই বা গড়ে উঠেছে পরিকাঠামো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিজের মতো করেই অনুশীলনের কঠোর পন্থা বেছে নিলেন মিলখা। কখনো কোমরে গাড়ির টায়ার বেঁধে দৌড়, কখনো বা বালির ওপরে।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকে দড়ি-টানাটানির প্রতিযোগিতা, অংশ নিত একাধিক ‘ক্লাব’ও
১৯৫৮ সালে প্রথম সাফল্য এল এশিয়ান গেমসে। দু’দুটি স্বর্ণপদক। তার মাস খানেকের পরই কার্ডিফ কমনওয়েলথ। সেখানেও সোনা ঝরালেন তিনি। অথচ, সে প্রতিযোগিতায় পুরোপুরিই অনালোচিত ছিল তাঁর নাম। স্টেডিয়ামেও ভারতের সমর্থক মাত্র ২ জন। তাঁর মধ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী। ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যেন কয়েক মুহূর্ত চুপ ছিল গোটা স্টেডিয়াম। সকলেই হতবাক।
আরও পড়ুন
১২০ বছর আগে, অলিম্পিকে খেলা হয়েছিল ক্রিকেটও; স্বর্ণপদক জিতেছিল কোন দেশ?
১৯৬০ সালে অলিম্পিকের মঞ্চেও ভারতের আশার আলো ছিলেন তিনিই। তবে সেই দৌড় শেষ করতে হয় চতুর্থ স্থানে গিয়েই। সামান্যের জন্য ব্রোঞ্জ ছিনিয়ে নেন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ স্পেন্স। রেসিং ট্র্যাকে পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলেন মিলখা— এমনই এক কিংবদন্তি রয়েছে ’৬০-এর সেই অলিম্পিক ঘিরে।
ওই একই বছর, পাকিস্তানে একটি প্রীতি দৌড়ে ২০০ মিটারে ব্যক্তিগত রেকর্ড তৈরি করেন মিলখা সিং। তাঁর গতিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘ফ্লাইং শিখ’ আখ্যা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান।
এরপর ১৯৬২-র জাকার্তা এশিয়ান গেমসেও জোড়া স্বর্ণপদক এনেছিলেন মিলখা। তবে অধরাই থেকে যায় অলিম্পিক জয়ের স্বপ্ন। শেষ বয়সে এসেও একাধিকবার সে-কথা উঠে এসেছিল তাঁর স্মৃতিচারণে। আজও তাঁর সমতুল্য দ্বিতীয় কোনো অ্যাথলিটকে কি পেয়েছে ভারত? জানা নেই উত্তর…
Powered by Froala Editor