Powered by Froala Editor
হয়ে ওঠা সৌমিত্র
১/১৪
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল আলাদা। কিন্তু ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে এনে ফেলেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, এই সিনেমায় রয়েছেন ছবি বিশ্বাস। বাংলা সিনেমার জগতে তখন ছবি বিশ্বাসের ভয়ে কাঁপেন সকলে। অথচ তরুণ অভিনেতাকে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। শিখিয়ে দিয়েছিলেন অভিনয় জীবনের মূলমন্ত্রটিও।
২/১৪
‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর শুটিং-এর প্রথম দিন ভয়ে ভয়ে ছবি বিশ্বাসের সামনে হাজির সৌমিত্র। বললেন, তাঁর কোথাও ভুল হলে যেন শুধরে দেন। ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন, “যা করবি, কনফিডেন্টলি করবি। ভুল করলে সেটাও কনফিডেন্টলি করবি।” সেইসঙ্গে এটাও বলেছিলেন, হয়তো তাঁর চোখে যেটা ভুল বলে মনে হচ্ছে, সেটাই চরিত্রটাকে অন্য দিক থেকে দেখা।
৩/১৪
বাংলা সিনেমার সুবর্ণযুগের প্রতিনিধিরা সবাই একে একে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ছেড়ে গেছেন সৌমিত্রও। কিন্তু যেতে চাইলেই কি তাঁদের যেতে দেওয়া যায়? বাঙালির মননে, চিন্তনে অপুর মতোই চিরপথিক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শিল্পী জীবনের যাত্রাপথে অনায়াসে মিলেমিশে গিয়েছেন বাকিদের সঙ্গেও। সিনেমার বাইরের সেইসব গল্পগুলোও চিরকালের সম্পদ।
৪/১৪
একদিকে উত্তমকুমার, অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একই ইন্ডাস্ট্রিতে এমন সময় খুব একটা আসে না। তবে উত্তমকুমারের কাছেও পেশাদারিত্ব শিখেছেন সৌমিত্র। একবার ঝিন্দের বন্দি সিনেমার শুটিং-এর সময় পরিচালকের আগেই উত্তমকুমার কাট বলে উঠেছিলেন। তপন সিংহ প্রশ্ন করলে উত্তমকুমার বলেছিলেন একটা ছোটো ভুল হয়ে গিয়েছে। রিটেক নিতে হবে। ক্যামেরার সামনে ‘নট গুড’ শটকেও কতটা সহজভাবে সামলানো যায়, তা অবাক করেছিল সৌমিত্রকে।
৫/১৪
এমনকি সিনেমার গানে লিপ দেওয়ার বিষয়েও নিখুঁত হতে শিখিয়েছিলেন উত্তমকুমার। বাংলা সিনেমার গানে লিপ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্বই দিতেন না সৌমিত্র। কিন্তু যখন দেখলেন, উত্তমকুমার তাঁর লিপ দেওয়া প্রতিটি গান নিজে অপূর্ব গাইতে পারেন – তখন বুঝেছিলেন, এর পিছনেও অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে।
৬/১৪
তাই সিনেমার দর্শকদের মধ্যে যতই উত্তর-সৌমিত্র বিভাজন থাক, দুই কিংবদন্তির সম্পর্কের জায়গায় সেই প্রভাব পড়েনি কোনোদিন। টালিগঞ্জের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে যখন অভিনেতারা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যান, বিরোধী দুই শিবিরের মুখ হয়ে উঠেছিলেন উত্তম এবং সৌমিত্র। এই দ্বন্দ্ব কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল ব্যক্তিগত জীবনে। কিন্তু তারপরেও সামনাসামনি দেখা হলে উত্তমকুমারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন সৌমিত্র, তাঁকে দেখেছেন বড়ো দাদার মতোই।
৭/১৪
উত্তমকুমারেরই ছেড়ে দেওয়া চরিত্র ‘ক্ষিদ্দা’ পরবর্তীকালে সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে একটা বড়ো বাঁকবদল ঘটিয়েছিল। মতি নন্দীর ‘কনি’ উপন্যাসটি পড়ার পর থেকেই এই ক্ষিদ্দা চরিত্রটির প্রতি টান অনুভব করতেন সৌমিত্র। তেমনই আরেকটি চরিত্র ছিল অবশ্যই ফেলুদা। অবশ্য সত্যজিৎ রায় কোনোদিন ফেলুদা নিয়ে সিনেমা বানাবেন, এবং ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্রকেই নেবেন – এমনটা ভাবতে পারেননি তিনি। তবু এত বছর পরেও আজও বাঙালির কাছে ফেলুদা মানেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
৮/১৪
তবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সবচেয়ে স্মরণীয় কাজের কথা উঠলেই সৌমিত্র ফিরে গিয়েছেন ‘অশনি সংকেত’-এর স্মৃতিতে। নায়কের আড়ালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো চরিত্রাভিনেতা হয়েই থাকতে চেয়েছেন। আর সেই জায়গাটা সবচেয়ে ভালোভাবে পেয়েছিলেন এখানেই।
৯/১৪
সেই বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার পায় ‘অশনি সংকেত’। সেরা অভিনেতার পুরস্কারও হয়তো পেতে পারতেন সৌমিত্র। কিন্তু একটি সিনেমা দুটি বিভাগে পুরস্কার পেতে পারে না – উৎসবের এই নিয়মের জন্যই তা সম্ভব হয়নি। সেই বছর কেউই বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাননি।
১০/১৪
খোদ নাসিরুদ্দিন শাহ কুরসোয়ার ছবি ছেড়ে একটানা বসে দেখেছিলেন ‘অশনি সংকেত’। ফ্রান্সের ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যালে নাসিরুদ্দিন একবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রিয় অভিনেতার তালিকায় রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তবে দুজনেরই পছন্দের অভিনেতা ছিলেন বলরাজ সাহানি।
১১/১৪
আরও একটি মিল ছিল দুই অভিনেতার। অভিনয়ের আগে চরিত্রগুলিকে বোঝার জন্য দুজনেই সমান পরিশ্রম করতে প্রস্তুত ছিলেন। দৃষ্টিহীনের চরিত্রে অভিনয়ের আগে কাছ থেকে তাঁদের চলাফেরা দেখেছেন সৌমিত্র। ‘হুইল চেয়ার’ সিনেমার আগে দীর্ঘদিন হুইল চেয়ার টানা অভ্যেস করেছেন। তবু অভিনয় জীবন আর ব্যক্তিগত জীবনকে কখনও মিলিয়ে দেননি তিনি।
১২/১৪
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের সঙ্গে আরেকটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছেন তাঁর নায়িকারা। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, তনুজার সঙ্গে তাঁর সখ্যের কথা তো সবারই জানা। তবে সৌমিত্র মনে করতেন, তাঁর নায়িকাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এই বন্ধুত্বের কথাও অনেকের অজানা। তবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধেই প্রথম ছোটো পর্দায় পা রেখেছিলেন সৌমিত্র।
১৩/১৪
টালিগঞ্জের বহু শিল্পীর সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছিল সৌমিত্রের। তবে একজনকে দেখেছেন অনেকটা দূর থেকে। তিনি সুচিত্রা সেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’-তে একসঙ্গে অভিনয়ের পরেও দূরত্বটা থেকেই গিয়েছে। সবার থেকে কীভাবে নিজেকে আলাদা রাখতে হয়, সেটা সুচিত্রার থেকেই শিখেছিলেন সৌমিত্র। তবে সেই শিক্ষাকে কোনোদিন গ্রহণ করতে পারেননি। বরং নিজেকে কিছুটা ভেঙে আরও বেশি জীবনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারলে সুচিত্রা শিল্পী হিসাবে আরও উন্নতি করতে পারতেন, এমনটাই মনে করতেন তিনি।
১৪/১৪
জীবন থেকে কোনোদিন দূরে সরে যেতে পারেননি বলেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্টার হয়েও সেই খোপের মধ্যে আটকে থাকেননি। সিনেমার লাইমলাইট ছেড়ে সৌমিত্র নিজে নাটকের মঞ্চে নামবেন, প্রথমে বিশ্বাস করেননি দর্শকরাও। কিন্তু নিরন্তর এই অনুশীলনই যে তাঁকে তৈরি করেছে। ঠিক এক বছর আগে সেই অনুশীলনের যাত্রা শেষ হয়ে গিয়েছে। তবু পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছে কি? চরিত্ররা যেন আজও টেনে নিয়ে চলেছে তাঁর যাত্রাপথ। ক্ষিদ্দা হয়তো বলছেন, ‘ফাইট! পুলু ফাইট!’