পঞ্চদশ শতক। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড— সমগ্র ইউরোপ জুড়েই তখন খেলছে নতুন সৃজনীর আন্দোলন। দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পের হাত ধরেই পুনর্জন্ম নিচ্ছে ইউরোপ। রেনেসাঁর সেই সূচনাপর্বেই একটা নতুন যুগ শুরু হল জার্মান এক আবিষ্কর্তার হাত ধরে। জোহানেস গুটেনবার্গ। প্রিন্টিং বা মুদ্রণের পথিকৃৎ হিসাবে উঠে আসে তাঁর কথাই। কিন্তু গুটেনবার্গই কি প্রথম আবিষ্কর্তা ছিলেন মুদ্রণযন্ত্রের?
ইতিহাস অন্য কথাই বলে। মুদ্রণ জগতে বিপ্লব এসেছিল তাঁর হাতে ধরেই। তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু এই জার্মান উদ্ভাবকের জন্মের আগে থেকেই চলে আসছে প্রিন্টিংয়ের প্রিমিটিভ পদ্ধতি। হস্তাক্ষরের পরিবর্তে সেখানে ছাপার কাজ হত যন্ত্রের ব্যবহারেই।
অক্ষর এবং বর্ণমালার মুদ্রিত রূপ খুঁজতে সভ্যতা চেষ্টা শুরু করেছিল প্রায় ৮০০ শতাব্দী নাগাদ। প্রথমে কাঠ বা কোনো পাথরে খোদাই করেই আঁকা হত বর্ণ বা ছবি। তারপর তাতে কালির প্রলেপ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হত কাগজ বা কাপড়। হুবহু ছাপ উঠে আসত সেখানে। এভাবেই ছাপা একাধিক চিঠির অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে বলাই বাহুল্য অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ছিল এই প্রক্রিয়া।
কাজেই সময় বাঁচাতেই দরকার হয়ে পড়েছিল প্রিন্টিং মেশিনের। যার মাধ্যমে আরও সহজে ও দ্রুততার সঙ্গেই টাইপ করা সম্ভব হবে প্রতিটি শব্দ, চিহ্ন, প্রতীক। চিনের ইয়ানসান শহরের বাসিন্দা দ্বি শেং নামক এক ব্যক্তিই প্রথম তৈরি করলেন এমনই এক অস্থাবর টাইপ মেশিন। যা গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের প্রিমিটিভ সংস্করণ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সময়টা আনুমানিক ৯৭০-১০৫১ খ্রিষ্টাব্দ।
তবে শেংয়ের মুদ্রিত কোনো নথির হদিশই পাওয়া যায়নি কখনও। ছিল না তাঁর লেখা কোনো বই-ও। তবে তাঁর কথা উল্লেখ করা হচ্ছে কেন জোর গলায়? চিনের ইতিহাস খুঁজলে আরেক ব্যক্তি ওয়াং জেনের লেখা একটি মুদ্রিত বই পাওয়া যায়। যার জন্ম ১৩১৩ সালে। কৃষিকাজের ওপর লিখিত সেই বইতেই বিশদ বিবরণ রয়েছে শেংয়ের মুদ্রণের। কীভাবে তাঁর তৈরি ডিভাইস বিবর্তিত হল, তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় সেখান থেকেই। ওয়াং জেনের বিবৃতিতেই জানা যায়, মোঙ্গল আক্রমণের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল শেংয়ের সমস্ত কাজ। তাছাড়া তাঁর তৈরি যন্ত্র মূলত ব্যবহার করা হত বার্তাপ্রেরক হিসাবেই।
তবে গুটেনবার্গের উত্তরসূরীদের তালিকে এখানেই শেষ নয়। মুদ্রণপ্রক্রিয়ার বেশ ভালোরকম বাজার ছিল কোরিয়াতেও। ধর্মগ্রন্থ রচনা এবং ধর্মপ্রচারের জন্যই সেসময় প্রয়োজন হয়েছিল মুদ্রণের। বৌদ্ধমঠেই তাই জন্ম নিয়েছিল টাইপ-প্রযুক্তি। বেগুন নামে এক কোরিয়ান সন্ন্যাসী ব্যক্তি তৈরি করেছিলেন ধাতুর তৈরি মুদ্রণযন্ত্র।
গুটেনবার্গের জন্মের প্রায় ১৫০ বছর আগে আরও এক কোরিয়ান ব্যক্তি চোয়-উন-উই বানিয়ে ফেলেছিলেন গুটেনবার্গের অনুরূপ যন্ত্রও। তাতে ছাপা হয়েছিল একাধিক কোরিয়ান পুঁথিও। তবে গুটেনবার্গের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েনি তার কথা। বরং কোরিয়ার ভূভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল তার খ্যাতি।
পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে কখনোই ব্যবহৃত হয়নি এই যন্ত্র। পাশাপাশি ইউরোপ যত শক্তি বৃদ্ধি করেছে নিজের, ততই গৌণ হয়ে এসেছে এশিয়ার এই দেশগুলির ইতিহাসই। তবে গণ-মুদ্রণের পথ প্রথম দেখিয়েছিলেন গুটেনবার্গই। সারা পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মুদ্রণ শিল্পের রহস্য, প্রযুক্তি। সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে প্রথম বাণিজ্যিক সাফলে এসেছিল তাঁর হাত ধরেই। কিন্তু মুদ্রণযন্ত্র তৈরির জন্য ন্যূনতম স্বীকৃতি মেলেনি তাঁর পূর্বসূরীদের। তাঁরা না থাকলে হয়তো এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গুটেনবার্গের প্রযুক্তি এসে পৌঁছতে সময় লেগে যেত আরও কয়েক শতক। তবে গুটেনবার্গ নিজে কোনোভাবে চোয়-উন-উই বা বেগুনের তৈরি যন্ত্রের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিনা, সে-ব্যাপারে কোনো তথ্যই আর পাওয়া যায়নি মুছে যাওয়া ইতিহাস থেকে...
তথ্যসূত্র-
১. So, Gutenberg Didn’t Actually Invent the Printing Press, M. Sophia Newman, Lithub
২. Did Gutenberg Invent The First Printing Press?, Ripleys
Powered by Froala Editor