স্বপ্ন নিয়ে প্রত্যাবর্তন নেদারল্যান্ডসের, ‘টোটাল ক্রিকেট’-এর জন্ম হবে কি?

কমলা জার্সি পরে মাঠে নামছে একটি দল। গত বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ইউরোপের এই দেশটি। নিশ্চয়ই এবার সমর্থকদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী থাকবে? কিন্তু কোথায় সেই উন্মাদনা? গ্যালারিতে নেই কোনো কমলা ঝড়। দূরবীন দিয়ে হয়তো খুঁজে দেখতে হবে সমর্থকদের। বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়! খেলার মাঠে নেদারল্যান্ডস বলতে তো এখন আসলে মনে পড়ে ভার্জিল ভ্যান ডাইক, ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ংদের কথা। কিংবা ২০১০-র ফুটবল বিশ্বকাপে স্নেইডার, রবেন, ভ্যান পার্সিদের সেই মন মাতানো ফুটবল। সেই মহাযজ্ঞে ক্রিকেটের স্থান তো দূর কোনো গ্রহে। ‘টোটাল ফুটবল’-এর আবিষ্কর্তার দেশের ক্রিকেট দলই এবার লিখে ফেলেছে ‘আন্ডারডগ’-এর গল্প। ২০২৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপের (Cricket World Cup) টেবিল যাই বলুক না কেন, শুধু শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা যাবে না তাদের যাত্রাপথকে।

১০ দলের বিশ্বকাপে সবার শেষে নেদারল্যান্ডস (Netherlands Cricket Team)। মাত্র দুটি ম্যাচ জিতেছে তারা। নেট রানরেট সবচেয়ে খারাপ। এবারের বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে সর্বোচ্চ রান হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যখন ভারত ৪১০ রানের পাহাড় চাপিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসের উপর। কিন্তু তারপরেও স্বপ্ন দেখার জন্য বেছে নেওয়া যায় কমলা জার্সিদের। তার একটা কারণ তো অবশ্যই ক্রিকেটীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো মহাশক্তিশালী দলকে মাত্র ২০৭ রানে বন্দি করে ৩৮ রানে ম্যাচ জিতে নেয় তারা। যে দক্ষিণ আফ্রিকা ঠিক তার আগের ম্যাচেই ৩০০-র উপর রান করেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আর পরের ম্যাচে ৩৯৯ রান করেছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। আরেকটি ম্যাচে নেদারল্যান্ডস মাত্র ১৪২ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশকে।

মাত্র দুটি জয়! ঝুলিতে চার পয়েন্ট। খাতায়-কলমে এক দুর্বল টিম। হারকে প্রায় অভ্যাসে পরিণত করা একটি দল। এই নিয়েও কি গল্প বলা যায়? হ্যাঁ, বলা যায়। যদি তাকানো যায় একটু অতীতের দিকে। কিংবা ভারতের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে হাজারো উৎসাহী চোখের সামনে দাঁড়িয়ে যখন ক্রিকেটের উৎসবে অংশগ্রহণ করার আনন্দ ঝরে পড়ে তাদের প্রতিটি চলন থেকে। এবছরের জুন মাসের কথা। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে মুখোমুখি নেদারল্যান্ডস ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ৩৭৪ রান। অবিশ্বাস্য রানের লক্ষ্য। অসম্ভব বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। কিন্তু রূপকথার জন্ম দেওয়ার জন্যই ব্যাট হাতে তুলে নিয়েছে তারা। নেদারল্যান্ডসের ইনিংসও শেষ হয় ৩৭৪ রানে। ম্যাচ ড্র। এবার সুপার ওভারের পালা। প্রথমে ব্যাট করে এক ওভারে নেদারল্যান্ডসের রান ৩০। জবারে মাত্র ৮ রানে আটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেদিনই যেন নিশ্চিত হয়ে গেছিল বিশ্বকাপের টিকিট। অন্তত জন্ম হয়েছিল এক বিশ্বাসের। বাকি কাজটা শেষ হয় স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর।

এবার ভারতে আসার প্রস্তুতি। উত্তেজনায় ফুটছে গোটা দল। কিন্তু স্পনসর? জোহান ক্রুয়েফের দেশের ক্রিকেট দলের জন্য এত বড়ো খরচের দায়িত্ব বহন করবে কে? অপেক্ষা চলল কিছুদিন। না, কোনো খবর নেই। শেষ পর্যন্ত দলের কোচ রায়ান কুক অনুরোধ রাখলেন সর্বসমক্ষে। যাতে ভারতের মাটিতে কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার বন্দোবস্ত করা যায়। তখন বোধহয় কেউ জানত না, দেশের ক্রিকেটের বিশ্বকাপের ইতিহাসে ‘শ্রেষ্ঠ’ দল হিসেবে প্রত্যাবর্তন ঘটবে স্কট এডওয়ার্ডসদের। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বকাপ খেলছে তারা। এর আগে শেষবার যোগ্যতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। ২০১৫ আর ২০১৯-এর বিশ্বকাপে সেই সৌভাগ্যও জোটেনি। আর পাঁচবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার পরেও মোট জয়ের সংখ্যা মাত্র দুই। তাও নামিবিয়া আর স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কে ভেবেছিল সেই দলটাই এবার হারিয়ে দেবে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিধর দলকে?

আরও পড়ুন
ক্রিকেট বিশ্বকাপে ‘নবরস’, কী অর্থ বোঝায় চিহ্নগুলি?

কী করেই বা কল্পনা করবে এরকম ঐতিহাসিক সফরের কথা? যে খেলোয়াড়রা প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছে ‘ডাচ’দের, তাদের রেকর্ডও তো আহামরি কিছু নয়। ধরা যাক, পল ভন মিকেরেনের কথা। দ্রুতগতির এই বোলার বছর কয়েক আগেও কাজ করতেন একটি খাবার সরবরাহকারী সংস্থায়। কিংবা ৩৮ বছর বয়সী ভ্যান ডার মারউয়ি। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের অন্যতম জয়ের নায়ক কিন্তু একসময়ে খেলতেন সে দেশের হয়েই। দাঙ্গাবিধ্বস্ত জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা এক পরিবারে জন্ম ওপেনার বিক্রমজিৎ সিংয়ের। ক্রিকেট যেন হয়ে উঠল তাঁর প্রত্যাবর্তনের গল্প। আর কেই-বা চিনত অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসকে? দল যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়েছেন তিনি। সব ম্যাচ হয়তো জেতাতে পারেননি, কিন্তু মন জিতে নিয়েছেন বারবার।

আরও পড়ুন
পুরুষ নয়, প্রথম চালু হয়েছিল মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ

এবারের বিশ্বকাপ খালি হাতে ফিরিয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের মতো দলকে। যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখানে নতুন শক্তির সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হল নেদারল্যান্ডস। স্কোরবোর্ড যাই বলুক, ভারতীয় সমর্থকরা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে তাদের। এই উৎসাহ নিয়েই ফিরে যাওয়া। খুঁজে পাওয়া এক নতুন আত্মবিশ্বাস। ‘টোটাল ফুটবল’-এর দেশে কি ‘টোটাল ক্রিকেট’-এর জন্ম হবে? অপেক্ষা করাই যায়...

Powered by Froala Editor