ভুবনগ্রামের মায়া ও মোহ তখনও বাঙালিকে আমূল বদলে দেয়নি। বহিরাঙ্গে তখনও পালটাহাওয়ার ওলটপালট নেই। তবে, ভিতরে ভিতরে একটা প্রস্তুতি, সময়ের তাগিদ হয়তো ছিল। এহেন সময়কালের বাঙালি সিনেপ্রেমীদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরার সেরা বিজ্ঞাপনবয় অবধারিতভাবেই তাপস পাল।
দর্শকদের মধ্যে সাহেব-এর বিপুল জনপ্রিয় আজ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, তখনও যৌথ পরিবারের ধারণা কতখানি আদৃত। আর বছরকয়েক পরেই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, পাড়া উঠে যাওয়া আর ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটের বিচ্ছিন্ন বসবাসের অবসাদ আমাদের পেড়ে ফেলবে। ওদিকে সাহেব শুধু নিজের পরিবারের জন্য ভাবছে তা নয়, বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে নিজেকে ভেঙে বেরোনো কথা। 'আমি' থেকে বেরিয়ে 'আমরা' হয়ে বাঁচার কথা। সাহেব তাই তুমুল ধনী নয়, ইংরেজি বলা কর্পোরেট সাহেবও নয়, সাহেব হৃদয়ের প্রসারতায় বাজিমাত করে। সেই হিসেবে সাহেব নামটি তার সার্থক, আবার সাহেবদের প্রতি ব্যঙ্গও বটে। এহেন একটি চরিত্রের জন্য যে সারল্য ও নিয়ন্ত্রণ দরকার, তাপস তা অসামান্য আয়ত্ত করেছিলেন।
তাপস পালকে, অভিনেতা তাপসকে বাঙালি তাই হৃদয় দিয়েই ভালোবেসেছিল। গ্রাম-গঞ্জ-মফঃস্বলের মানুষকে হলে টানার জন্য তিনি ছিলেন অন্যতম মুখ। প্রসেনজিৎ ভক্ত এবং তাপস ভক্তদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বও থাকত। প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটি সে সময় অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে শহরের পিনকোড ছাড়িয়ে প্রান্ত থেকে প্রান্তরে। প্রায় সমসময়ে, তাপস-শতাব্দী জুটিও ছিল দারুণ জনপ্রিয়। তারও একটু আগে তাপস-দেবশ্রী জুটি ছিল একেবারে নয়নের মণি, সম্ভবত 'ভালোবাসা ভালোবাসা' দৌলতে। এক পাড়ার জলসায় কোনোভাবে প্রসেনজিৎ এলে, 'রাইভাল' পাড়া তাপস পাল নাইট করে টেক্কা দিত। পাড়ার পুজো উপলক্ষে কিংবা পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে অনেক লোককে জাগিয়ে রাখার পুণ্যকর্মে ভিসিআর ভাড়া হলে, প্রসেনজিতকে অপেক্ষা করতে হত। কারণ, সবার আগে বর্ষীয়ানদের সমবেত দাবিতে চলত তাপসের কোনও 'ঘরোয়া' সিনেমা। হ্যাঁ, অ্যাকশন প্রিয় তরুণরা গোড়ায় উশখুশ করলেও, শেষমেশ মজেই যেত গল্পের টানে। অথচ সে সময়ের সিনেমা দেখলে বোঝা যায়, বহু গল্পেই বিরাট কোনও মোচড় নেই। খানিকটা তরল, একটু বেশিই আবেগ। প্রযুক্তির ব্যবহারও সামান্য, কারণ বাজেট কম। এই সবের ভিতর বসেও কী করে একজন অভিনেতা তাঁর দর্শককে ঠায় বসিয়ে রাখতে পারতেন, সে রহস্য নিয়ে বাংলা সিনেমার ইতিহাস রচয়িতারা নিশ্চিত মনোযোগী হবেন। আমাদের শুধু মনে পড়বে, গঞ্জের ইটপাতা রাস্তায় ভ্যানে বসে কেউ একজন বলে চলেছে, শ্রেষ্ঠাংশে তাপস পাল…। বার তিনেক ইকো হয়ে সে নাম মিলিয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পাতলা কাগজেত হলুদ লিফলেট। তাতে একটা ছবি পাওয়া মানে জমিয়ে রাখার ব্যাপার।
সেই সময় খুব বলা হত, লেখাও থাকত পোস্টারে, ছোট-বড় সকলকে নিয়ে দেখার ছবি। তাপস এই মানসিকতার, দর্শকের এই যৌথতাকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন সার্থকভাবে। এবং, শেষমেশ জিতিয়ে দিতে চেয়েছেন এমন এক বাঙালিকে, যে গুণে-মানে, মানসিক ঔদার্যে জিতে যায়। এমনকি জীবনেত সফলতা অধরা থাকলেও, সিনেমার বাস্তবতা তাকে 'শেষ সিনে' জিতিয়ে দেওয়ার, অনেক আগেই সে জিতে যায়। বাঙালির এই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাবে অচিরেই। অথচ আট কি নয়ের গোড়াতেও এক শ্রেণীর মানুষের মনে হত, সেটাকেই আঁকড়ে ধরা উচিত। সব ধুলোবালি হয়ে যাওয়ার আগে তাপসের চরিত্ররা 'গুরুদক্ষিণা' দিয়ে গেল সেই বাঙালিয়ানাকে; ভালোবাসার সেই সরল প্রকাশের দিনকালকে; গান কিংবা ফুটবল, নিজের প্যাশনকে আঁকড়ে থাকার প্যাশনকে; সর্বোপরি, অর্থবান হওয়াই সফলতার মাপকাঠি, এই ধারণার উল্টোদিকে দাঁড়ানোর সাহসকে।
বাংলা সিনেমায় অভিনেতা তাপস পাল মাইলফলক না হলেও, নিশ্চিতই এমন এক যতিচিহ্ন, যার সামনে বাঙালিকে থমকে দাঁড়াতেই হবে। তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।