সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার উত্তরপ্রদেশে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আড়ালে কি কণ্ঠরোধের চেষ্টা?

অপরাধীদের পাকড়াও করার নামগন্ধ নেই, অথচ হাথরাসের ঘটনার কভারেজে যাওয়া সাংবাদিকদের হেনস্থা করা চলছেই। এবার উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে যাওয়ার পথে উগ্রপন্থী সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’র সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হল চার সাংবাদিককে। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করা হয়েছে। প্রসঙ্গত আদিত্যনাথ সরকার গত বছর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পরবর্তী ভাঙচুরের জন্য এই একই সংস্থাকে দোষ দিয়েছিল।

যোগী প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, তাঁরা “বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য হাথরাসে যাচ্ছিল"। এছাড়াও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ কঠোর বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইনের ধারা অনুযায়ী জানিয়েছে যে এঁরা যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ করে। তার সঙ্গেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার ও ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রভাবিত করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি আইনের একাধিক ধারাতেও তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

হাথরাসে দলিত মহিলার উপর গণধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন দেশব্যাপী ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সেই সম্পর্কিত খবর করতেই সাংবাদিকদের একটি দল রওয়ানা দিয়েছিল হাথরাসের উদ্দেশ্যে। এই খবর জানতে পেরেই আতিক উর রেহমান, সিদ্দিক কপ্পান, মাসুদ আহমেদ ও আলম— এই চারজনকে রাজ্য পুলিশ মথুরার একটি টোল প্লাজায় থামিয়ে দেয়। পুলিশের বক্তব্য, তাঁদের কাছে খবর ছিল যে, কিছু ‘সন্দেহভাজন লোক’ দিল্লি থেকে রওনা দিয়েছে। যদিও পুলিশ জানিয়েছে এঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা ১৫১-এর অধীনে প্রতিরোধমূলক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও, কোনো এফআইআর তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়নি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সামনে এঁরা পিএফআই এবং সিএফআই (ভারতের ক্যাম্পাস ফ্রন্ট)-এর সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি তাঁদের মোবাইল ফোন সহ, ল্যাপটপ ও আরও কিছু জরুরি কাগজপত্রও বাজেয়াপ্ত করা হয়।

সাংবাদিক সিদ্দিক কপ্পান শুধু কেরল ইউনিয়নের ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংস্থার সদস্যই নন, তাদের দিল্লি ইউনিটের সেক্রেটারিও বটে। পেশার খাতিরেই হাথরাসের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে যাচ্ছিলেন তিনি।  কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ভাবে এঁদের গ্রেপ্তার করা হল, তাতে যোগী রাজ্যে ঠিক কতটা গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদালতে তোলার পর এই চারজনকে ১৪ দিনের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, এই তদন্ত এখনই থামবে না।

এই ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে দেশের সাংবাদিক মহল। কেরালা ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংস্থার তরফে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথকে চিঠি দিয়ে কপ্পানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। বস্তুত, উত্তরপ্রদেশ সরকার কপ্পানকে গ্রেপ্তারির বিষয়ে কোনো তথ্যই জানায়নি বলে জানানো হয়েছে। সাংবাদিকদেরও যদি স্বাধীন ভাবে নিজেদের কাজ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে রাজ্যের পরিস্থিটিটা ঠিক কী, সেটাও সহজেই অনুমেয়। আদিত্যনাথের সঙ্গেই ওই সংস্থা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও চিঠি দিয়ে কপ্পানের মুক্তির জন্য ‘জরুরি পদক্ষেপ’ দাবি করেছিল।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের দলিত মহিলা নির্যাতিত ও ধর্ষিত হওয়ার পর দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে মারা যান ২৯ সেপ্টেম্বর। মৃতার পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তড়িঘড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয় তাঁর দেহ। জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকাও এক্ষেত্রে দেখেছে সারা দেশ। মাথার উপর সরকারের হাত না থাকলে যে এটা সম্ভব নয়, তা সহজেই বোধগম্য। দেশ জুড়ে বিক্ষোভের পর রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে একাধিক কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যোগী সরকার। একের পর এক এফআইআর দায়ের করা হয়েছে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী

যদিও উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন নিয়মিতভাবে অস্বীকার করে আসছে যে, ওই মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ফরেনসিক ল্যাবের এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশের তরফে বলা হয়েছিল যে, মহিলার দেহে ধর্ষণের কোনও চিহ্ন মেলেনি। যদিও জওহরলাল নেহেরু মেডিকেল কলেজের চিফ মেডিকেল অফিসার, যেখানে এই মহিলাকে ভর্তি করা হয়েছিল, জানিয়েছেন যে, ফরেনসিক ল্যাব রিপোর্টটির আদতেই কোনো মূল্য নেই, কারণ এটি অপরাধের ১১ দিন পরে নেওয়া নমুনার উপর নির্ভর করে দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়াও মহিলার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছিল যে, গলা টিপেই হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। জরায়ুতেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তবু চূড়ান্ত রিপোর্টে ধর্ষণের উল্লেখ না থাকা রীতিমতো আশ্চর্যই করেছে তাঁকে।

তবু যোগী রাজ্য আছে নিজের মর্জিতেই। একাধিক নেতা বক্তব্য দিয়েছেন, ধর্ষণ আদৌ হয়নি। কেউ কেউ আবার দায়ী করেছেন মহিলার মন্দ স্বভাবকে। আর এই সব কিছুর মধ্যে গলা টিপে মারা হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাথমিক অধিকারের ব্যাপারগুলিকেও। এবং এই ধাক্কায় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যে রীতিমতো টলোমলো, তা বলাই বাহুল্য!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন পুরুষরাও; 'কুণ্ঠা'র আড়ালেই চাপা পড়ে প্রতিবাদ?

Powered by Froala Editor

More From Author See More