“ধর্ষণ কেন হয়, কীরকম মানসিকতা থেকে এর উৎপত্তি, এর কোনো নির্দিষ্ট উত্তর হয় না। কাজ করার সময় এই কথাটাই বারবার মনে হয়েছিল। প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এখনও আমাদের দেশের মজ্জায় ঢুকে আছে। ধর্ষণ শুধু শারীরিকই হয় না; তার বহিঃপ্রকাশ নানা রকম। রাস্তা আলাদা হলেও, উৎস কিন্তু একটাই। আমাদের সেই উৎসের বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলতে হবে। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার খারাপ দিকগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।”
প্রহরকে বলছিলেন প্রিয়াঙ্কা দুবে। সাংবাদিকতার জগতে পরিচিত একটি নাম। খাতা-পেন হাতে, রোদে জলে ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করা, সত্যি ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসাই তাঁর কাজ। এই কাজ করতে গিয়েই চোখ পড়েছিল ভারতের সমাজের দিকে। যেখানে একের পর এক মহিলারা রাস্তার ধারে বসে আছেন; রক্তাক্ত, নিগৃহীত হয়ে। ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়ার গণধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর একের পর এক রিপোর্ট সামনে আসতে থাকে। সেই হিংস্রতার ছবি দেখে আজও আমরা শিউরে উঠি। কিন্তু সেটাই কি সব? সমাজের ভেতরে বৃহত্তর ছবিটা আসলে কী? প্রশ্ন আসে প্রিয়াঙ্কার…
আর সেই সূত্রেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে গোটা ভারতের বুকে ঘুরে বেড়ান তিনি। গ্রাম থেকে শহর— সমস্ত জায়গায় পৌঁছে যান। লক্ষ্য একটাই, ভারতের ‘ধর্ষণ-চিত্র’-এর বাস্তব রূপ। তারই ফসল ‘No Nation for Women— Reportage on Rape from India, the World’s Largest Democracy’ বইটি। এই ছয়টি বছর আসলে আরও কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা জীবনের সারমর্ম। চোখে কালো কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকে আইন, হাতে নিক্তি আর তরোয়াল। সেই অন্ধ দৃষ্টির সামনেই পড়ে থাকে রক্ত। হাসতে থাকে পাশবিকতা…
“আজ উত্তরপ্রদেশের কথা প্রবলভাবে উঠে আসছে বলেই এই রাজ্যকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে ভারতের অন্যান্য জায়গা খুব সুরক্ষিত। তথ্য বলছে, ভারতে প্রতিদিন প্রায় ৭১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তার মানে প্রতি ১৫-১৬ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ! ভাবতে পারছেন? আর এই তথ্য কেবল পুলিশের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে। এর বাইরেও বহু ঘটনা ঘটে যা পুলিশের খাতা অবধি পৌঁছয়ই না। সেগুলোকে ধরলে এই সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে একবার ভাবুন”, বলছিলেন প্রিয়াঙ্কা। প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তে মেয়েদের নির্যাতিত হতে হচ্ছে। অথচ সেই আওয়াজ সামনে উঠে আসছে না। কেন? এই ‘কেন’-র জায়গাতেই আঘাত করা উচিত বলে মনে করছেন প্রিয়াঙ্কা। কেন পুলিশ-প্রশাসনের কাছে ভরসা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ, এই আত্মসমীক্ষা করার সময় এসে গেছে। উত্তরপ্রদেশ কেবলই একটি খণ্ডচিত্র মাত্র, আসল ছবি আমাদের সামনে ধরাই পড়েনি…
এই কাজটি করার সময় অনেক গ্রামে গিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা দুবে, অনেক নিগৃহীতা ও তাঁর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কখনও সামনে এসেছে ধর্মের প্রসঙ্গ, কখনও দলিত অত্যাচার, কখনও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। তাহলে একটা বা দুটো কারণকেই কেন আমরা চিহ্নিত করছি? শুধু তো শারীরিক নিগ্রহ নয়; ধর্ষণ লুকিয়ে আছে সাধারণ কথোপকথনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে মেয়েদের ছবির কমেন্টে ভেসে আসে একাধিক কটূক্তি, একটু বিখ্যাত কেউ হলে তো আর কথাই নেই। “এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটাই শব্দ— ক্ষমতা। ক্ষমতা কেবল রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, সামাজিকও বটে। মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেরোবে না, অমুক সময় ঘরে ঢুকে আসবে— এরকম হাজার হাজার বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখা হয় আমাদের। পিতৃতন্ত্রের ‘অসুখ’ তো এখানেই লুকিয়ে আছে!” তা না হলে, নির্ভয়ার ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের আইনজীবী এ.পি.সিং কী করে বলতে পারলেন ‘পোশাকের’ কথা?
আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী
অনেক সময় শোনা যায়, খাপ পঞ্চায়েতের ‘বিচারে’ নির্যাতিতাকে বাধ্য করা হয়েছে তাঁর ধর্ষককে বিয়ে করতে। মধ্যযুগে এমন প্রথা শোনা গেলেও, একবিংশ শতকের আধুনিক ভারতে দাঁড়িয়েও এই কথা শুনতে হয়! শুধু ধর্ষণই নয়, কন্যাভ্রূণ হত্যা এখনও ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। সংবিধান তো সকলকে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার দিয়েছে; তাহলে কেন এত বাধানিষেধ? কেন নির্যাতিতার পরিচয়ই বারবার ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়? ‘নির্যাতিতা’ তকমাটাও তো সমাজেরই দেওয়া। “সম্মান কি শুধু মেয়েদের যৌনতায় লুকিয়ে আছে? যেন ধর্ষণ করলেই তাঁকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে! এই ভাবধারাই দেশের প্রতিটি জায়গায় লুকিয়ে আছে। শিক্ষা নয়, চেতনা নয়, জ্ঞান বা কাজ নয়; শরীরই যেন সম্মানের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এটা কি মধ্যযুগীয় বর্বরতা নয়?” নিজের বইয়ে এসবেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দুবে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ‘গণতান্ত্রিক উদযাপন’ই যে আজ প্রশ্নের মুখে…
কথায় কথায় উঠে এল পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ। ছয় বছরের কাজের সূত্রে এখানেও এসেছেন প্রিয়াঙ্কা। এমন একটা সময় এসেছিলেন, যখন পার্ক স্ট্রিট, কামদুনির মতো ঘটনা ঘটে চলেছে রাজ্যে। প্রিয়াঙ্কা মনে করছিলেন বর্ধমানের এক মেধাবী ছাত্রীকে। মেয়েটি চেয়েছিল আরও, আরও পড়াশোনা করতে। সেইসঙ্গে সাহসের সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে জীবন কাটাতে। নিজের মা-বাবাকে নিয়ে আরও সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল সে। টিউশন পড়তে যাওয়ার সময় নির্মীয়মাণ বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসত কটূক্তি, আশ্রাব্য ইঙ্গিত। অনেকদিন দেখেছে সে; একদিন প্রতিবাদ করে এগিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, পুলিশে খবর দিয়ে দেবে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই নিখোঁজ হয় ওই মেয়েটি। পরে বাড়ির পাশে একটি খাল থেকে দেহ উদ্ধার করা হয়। গণধর্ষণ, সেইসঙ্গে নৃশংসভাবে খুন…
আরও পড়ুন
ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন পুরুষরাও; 'কুণ্ঠা'র আড়ালেই চাপা পড়ে প্রতিবাদ?
“মেয়েটির ভবিষ্যৎ তো শেষ হয়ে গেল পুরো। অথচ এই ঘটনা আমাদের সামনে সেভাবে এল না”, আফসোস প্রিয়াঙ্কার। এখানেই ইঙ্গিত করলেন সেই ক্ষমতার প্রসঙ্গ। যে ক্ষমতা, যে মানসিকতা, যে পিতৃতন্ত্র একটি ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণ করে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। যে ক্ষমতা একটি আট বছরের শিশুকে মন্দিরের ভেতর দিনের পর দিন ধর্ষণ করে। কেন বারবার ধর্ষণের মতো ঘটনার ভেতর খোঁজা হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণের সুতো? “আসলে এটা একটা চেন। একটা শৃঙ্খল। এখানে শুধু সমাজ নয়; প্রশাসন, পুলিশ, পরিবার, মিডিয়া সবাই জড়িয়ে আছে। আজও দেশের সিনে অভিনেত্রীদের প্রতিদিন অশ্রাব্য কথা শুনতে হয়। সেটাও তো ধর্ষণ!”
যতবার কথাগুলো বলছিলেন, যেন নিজের মনে মনেই সমাজের মুখে একটা করে থাপ্পড় দিচ্ছিলেন প্রিয়াঙ্কা দুবে। তিনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। এই ঘটনায় নিজেদের দোষও এড়িয়ে গেলেন না। “দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাইয়ের মতো জায়গায় কিছু ঘটলে আমরা পৌঁছে যাই। কিন্তু অন্য জায়গায় একই সময় সেই ঘটনা ঘটলে ক্যামেরা আর বুম পৌঁছয় না। হাথরাসের ঘটনা নিয়ে যখন মিডিয়া ব্যস্ত, তখন উত্তরপ্রদেশেরই অন্যান্য জায়গা থেকে ধর্ষণের খবর আসতে থাকে। সেই ঘটনাগুলো কি আলো পেয়েছে? আমাদের দরকার প্রতি মুহূর্তের রিপোর্টিং। প্রতি মুহূর্তে আমরা যদি সবাইকে জানাতে পারি, তখনই আসল ছবিটা ধরা পড়বে। এবং দৃঢ় হবে প্রতিবাদ।”
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়