১৯৩৮ সালের ১৭ই মে। কল্পবিজ্ঞান লেখার স্বপ্ন দেখা আঠেরো বছর বয়সি এক তরুণ উপস্থিত হয়েছে ‘স্ট্রিট অ্যান্ড স্মিথ পাবলিকেশনস’-এর দপ্তরে। উদ্দেশ্য তার প্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করা, এবং তাঁর হাতে নিজের প্রথম গল্প ‘কসমিক কর্কস্ক্রু’-র পাণ্ডুলিপি তুলে দেওয়া। তরুণের মনে ভয় ছিল, হয়তো ব্যস্ত সম্পাদক তার সঙ্গে দেখা করতে রাজিই হবেন না। কিন্তু সেই আশঙ্কা নস্যাৎ করে তরুণ লেখককে নিজের কেবিনে ডেকে নিলেন সম্পাদক, এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গল্পগাছা করলেন। সঙ্গে এও আশ্বাস দিলেন, খুব শিগগিরই গল্পটা পড়ে তাঁর অভিমত জানাবেন।
এর ঠিক দু’ দিন পর তরুণ লেখকের বাড়িতে একটা চিঠি এল। পত্রিকার সম্পাদকের চিঠি। তাতে লেখা ছিল, গল্পটা তিনি মন দিয়ে পড়েছেন, কিন্তু কতগুলো ত্রুটির কারণে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য মনোনীত করতে পারেননি। সেই ত্রুটিগুলো সুন্দর করে চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন সম্পাদক, পাশাপাশি নতুন লেখককে উৎসাহ দিয়ে আগামীদিনে আবার গল্প পাঠানোর অনুরোধও জানিয়েছিলেন।
অনেক বছর পর সেই লেখক সেই সম্পাদকের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, অত বাজে একটা গল্প পড়ার পরেও কেন তিনি নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে তার মতো একজন অনামী অখ্যাত লেখককে ওরকম আন্তরিক চিঠি লিখেছিলেন। উত্তরে সম্পাদক জানান, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল, তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে। যতবারই তোমার লেখা অমনোনীত হোক না কেন, তুমি হাল ছাড়বে না। তুমি পরিশ্রম করতে রাজি ছিলে, আর তাই আমিও তোমার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলাম।’
সেদিনের সেই তরুণ লেখককে আজ গোটা দুনিয়া আইজ্যাক আসিমভ নামে চেনে। আর সেই সম্পাদক? না, নামটা বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। তিনি জন উড ক্যাম্পবেল।
আরও পড়ুন
শঙ্কুর গল্প শুরুতে কি কল্পবিজ্ঞানের?
ক্যাম্পবেল-এর জন্ম হয় ৮ই জুন, ১৯১০ সালে, আমেরিকার নিউ জার্সি-তে। কিশোর বয়স থেকেই বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি, পাশাপাশি কল্পবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। আঠেরো বছর বয়সে এমআইটি-তে পড়াকালীনই তিনি খুচরো লেখালিখি শুরু করেন। ১৯৩০ সালে হুগো গার্নসব্যাক প্রবর্তিত সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা ‘আমেজিং স্টোরিজ’-এর জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘হোয়েন দ্য অ্যাটমস ফেইলড’। সে বছরই আরও পাঁচটা গল্প লেখেন ক্যাম্পবেল, যার মধ্যে তিনটে ছিল মহাকাশ অ্যাডভেঞ্চার। অল্প সময়ের মধ্যেই ‘স্পেস অপেরা’ ঘরানার লেখক হিসেবে নাম করেন ক্যাম্পবেল, ই ই ‘ডক’ স্মিথ-এর মতো সুপরিচিত লেখকের সঙ্গে একবাক্যে তাঁর নাম উচ্চারত হতে থাকে।
আরও পড়ুন
কল্পবিজ্ঞানের ‘শেক্সপিয়র’ তিনি, ১০০ বছর আগেই দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ
১৯৩৪ সাল থেকে নিজের নামের পরিবর্তে ডন এ স্টুয়ার্ট ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু করেন ক্যাম্পবেল, বদলে ফেলেন লেখার ধরনও। ‘টোয়াইলাইট’, ‘হু গোজ দেয়ার?’ জাতীয় তাঁর অনবদ্য নভেলা কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকের মন জিতে নেয় অনায়াসে (পরবর্তীতে ‘হু গোজ দেয়ার’ উপন্যাসিকার কাহিনি অবলম্বনে একাধিক হলিউড সিনেমাও নির্মিত হয়)। সায়েন্স ফিকশনের স্মরণীয় লেখকদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠার পথে আত্মবিশ্বাসী যাত্রা শুরু করেছেন, এমন সময়ে তাঁর জীবনে আসে এক বিরাট বাঁক-বদল। ১৯৩৭ সালে পাল্প পত্রিকা ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন ক্যাম্পবেল। এক বছর যেতে না যেতেই তিনি হয়ে ওঠেন পত্রিকার সর্বসময় কর্তা। সূচনা হয় ‘ক্যাম্পবেল রেভেলিউশন’-এর। একইসঙ্গে চিরকালের মতো ইতি পড়ে যায় তাঁর লেখালিখিতে।
আরও পড়ুন
‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী, ছাপ রেখেছেন রাজনীতিতেও
’৩০-এর দশকে পাল্প ম্যাগাজিনগুলোই ছিল আমেরিকান কল্পবিজ্ঞানের একমাত্র ধারক তথা বাহক। মারে লেইনস্টার, জ্যাক উইলিয়ামসন, জি স্ট্যানলি ওয়েইনবাউম-এর মতো দক্ষ লেখকরা সেখানে লিখতেন বটে, তবে আরও বেশি পরিমাণে লিখতেন ক্যাপ্টেন এস পি মিক, রে কামিংস-এর মতো মধ্যমেধার কলমচিরা। ফলে তৎকালীন কল্পবিজ্ঞান থেকে একপ্রকার বিদায়ই নিয়েছিল বিজ্ঞান, পড়ে ছিল গিমিকসর্বস্বতা, আজগুবি গেজেট এবং সস্তা অ্যাডভেঞ্চার। ভিনগ্রহী দানব এবং আসমানি লুটেরাদের মধ্যেকার অতিনাটকীয় লড়াইয়ের বিবরণ সায়েন্স ফিকশন শাখাটাকেই হাস্যকর করে তোলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন জন ক্যাম্পবেল। সম্পাদকীয় দায়িত্বগ্রহণের পর তাঁর প্রথম কাজই ছিল পত্রিকাকে ঢেলে সাজানো। এল স্প্রেগ ডেক্যাম্প, ক্লিফোর্ড সিম্যাক, হেনরি কাটনার, ক্যাথরিন এল মুর, আইজ্যাক আসিমভ, রবার্ট হাইনলাইন, এ ই ভ্যান ভট, এরিক ফ্র্যাঙ্ক রাসেল-দের নিয়ে দুর্ধর্ষ এক লেখকমণ্ডলী গড়লেন তিনি, অযোগ্য লেখকদের বাদ দিলেন নির্দ্বিধায়। এরপর তিনি মনোযোগ দিলেন পত্রিকার পাতায় আবেগবর্জিত, যুক্তিনির্ভর হার্ড সায়েন্স ফিকশন প্রবর্তনের দিকে। ক্রমশ তাঁর পছন্দের গল্প উপন্যাস পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। সমৃদ্ধির শিখর ছুঁল ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’।
একজন সম্পাদকের কর্তব্য কী হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন ক্যাম্পবেল। লেখকদের সঙ্গে নিয়ম করে বসতেন তিনি, ধৈর্য ধরে শুধরে দিতেন ভুলভ্রান্তি, অভিনব প্লট-এর বীজ বোনার ক্ষেত্রে তাঁদের সাহায্য করতেন। আসিমভ-এর রোবট সিরিজের প্রাণকেন্দ্র ‘থ্রি লজ অফ রোবোটিক্স’-এর নির্মাণ থেকে শুরু করে টম গডউইন-এর বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘দ্য কোল্ড ইকুয়েশনস’-এর শেষটা কেমন হওয়া উচিৎ তা ঠিক করে দেওয়া—ইতিহাস সাক্ষী, সবেতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ক্যাম্পবেল। সর্বকালের সেরা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের কিছু নিদর্শন—আসিমভ-এর ‘রোবট’ এবং ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ, হাইনলাইন-এর ‘ফিউচার হিস্ট্রি’ সিরিজ, ভ্যান ভট-এর উপন্যাস ‘স্ল্যান’ এবং ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ নাল এ’, হেনরি কাটনার-এর ‘ব্যাল্ডি’ সিরিজ—তাঁর আমলে, তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। একজন সম্পাদকের পক্ষে এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে!
গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশনের গঠনগত দিকগুলো নিয়েও ক্যাম্পবেল-এর কৌতূহলের অভাব ছিল না। ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকায় মনোগ্রাহী সম্পাদকীয় লিখতেন তিনি, সেখানে বিভিন্ন গল্পের কাটাছেঁড়া হত, গল্পে ব্যবহৃত আইডিয়াগুলো নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা চলত। গ্রাহকদের রীতিমতো উৎসাহ দিতেন তিনি, মতামত জানাতে, গল্পের ভালোমন্দ নিয়ে বক্তব্য রাখতে। প্রচুর চিঠি আসত পত্রিকা দপ্তরে, যাদের মধ্যে বাছাই করা কয়েকটা চিঠি নিষ্ঠাভরে ছাপতেন ক্যাম্পবেল। এছাড়া সময়ে সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক নিবন্ধও লিখতেন তিনি; তাঁর ধারালো কলমে উঠে আসত প্রযুক্তিগত উন্নতির খবরাখবর, মানবসমাজে বিজ্ঞানের প্রভাবে কী কী পরিবর্তন এসেছে তার খতিয়ান, এমনকি নানান ‘সিউডোসায়েন্টিফিক’ আবিষ্কারের খোঁজও। দৃঢ়ভাবে নিজের মতপ্রকাশ করতে ভালোবাসতেন ক্যাম্পবেল, পছন্দ করতেন গলা ফাটিয়ে তর্ক করতে। মাঝে মাঝে বিতর্ক উস্কে দিতে উত্তপ্ত রাজনৈতিক তরজার স্বপক্ষে বা বিপক্ষে মন্তব্য করতেও পিছপা হতেন না তিনি।
চল্লিশের দশকের শেষভাগ অবধি সাফল্যের সঙ্গে পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন ক্যাম্পবেল, প্রায় একার চেষ্টায় পাল্প যুগের কল্পবিজ্ঞানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন নতুন উচ্চতায়। তাঁর হাত ধরেই আগমন ঘটেছিল ‘গোল্ডেন এজ অফ সায়েন্স ফিকশন’-এর। কিন্তু তার পরেই শুরু হল ছন্দপতন। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পরিণতি দেখে ফেলা জনগণের মনে আশাবাদী, উচ্ছ্বাসপ্রবণ কল্পবিজ্ঞানের প্রতি অনাস্থা, অন্যদিকে ম্যাগাজিনের পাতায় নিউটন-এর সূত্র অগ্রাহ্য করে চিরস্থায়ীভাবে শক্তির জোগান দিয়ে যাওয়া যন্ত্র ‘ডিন ড্রাইভ’, মানুষের মনের অলৌকিক ক্ষমতা অর্থাৎ ইএসপি বাড়ানো হায়রোনিমাস মেশিন ইত্যাদি নিয়ে আদিখ্যেতা ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’এর সঙ্গে তার লেখক এবং গ্রাহকদের দূরত্ব সৃষ্টি করল। যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে হুজুগে মেতে উঠলেন ক্যাম্পবেল, এল রন হাবার্ড প্রণীত ‘ডায়নেটিক্স’ তত্ত্বের সমর্থনে দিস্তা দিস্তা নিউজপ্রিন্ট নষ্ট করতে লাগলেন। পরিণাম যা হওয়ার তাই হল, পত্রিকার মান এবং বিক্রি দুটোই পড়তে লাগল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও কয়েক বছর পার করার পর প্রতিযোগিতা থেকে একপ্রকার বিদায়ই নিল ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’। ষাটের দশকে পত্রিকার নাম পালটে ‘অ্যানালগ’ রেখে বাজারে ফিরে আসার চেষ্টাও খুব একটা সফল হল না। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ক্যাম্পবেল।
আজ জন উড ক্যাম্পবেল-এর পঞ্চাশতম প্রয়াণবার্ষিকী। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সায়েন্স ফিকশন’ যার সম্বন্ধে স্তুতি করে লিখেছে, ‘More than any other individual, he helped to shape modern SF’, শিষ্য তথা পরম সুহৃদ আসিমভ যাকে ‘the most powerful force in science fiction ever’-এর খেতাব দিয়েছেন, সেই কর্তব্যপরায়ণ সম্পাদকের সামান্য দোষ-ত্রুটি আমরা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতেই পারি, সম্মান জানাতে পারি সায়েন্স ফিকশনের প্রতি তাঁর নিখাদ ভালোবাসাকে, অন্তরে ধারণ করতে পারি স্পেকুলেটিভ সাহিত্যের উন্নতিকল্পে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের মন্ত্রকে। সেটাই হবে আমাদের পক্ষ থেকে কল্পবিজ্ঞানের কিংবদন্তির স্মৃতির প্রতি শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য।
Powered by Froala Editor