রাতের ডেলাওয়ার শহর। জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। সদ্য খ্রিস্টমাস পেরিয়ে যাওয়া শহরও তাই বেশ ফাঁকা। তবে এই শুনশান শূন্যতা মেখেও ডেলাওয়ারে মেমোরিয়াল ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন। রেলিংয়ের ধারে। প্রায় দেড়শো মিটার নিচে বয়ে যাচ্ছে হিমশীতল জলপ্রবাহ, ডেলাওয়ারে নদী। সেদিকেই ঠায় তাকিয়ে রয়েছেন ব্যক্তিটি। মুখ দিয়ে ঘন ঘন বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। দীর্ঘশ্বাসের। ঝাঁপ দেবেন তিনি?
যে সময়ের কথা হচ্ছে সেটা ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাস। পেরিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে বড়ো উৎসব বড়োদিন। তবে উৎসব তো নয়, যেন বিভীষিকা হয়েই ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে। তাঁর বলতে জো বাইডেন। দুঃখ, যন্ত্রণা আত্মহত্যার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল তাঁকে। তবে শেষ অবধি ঝাঁপ দিতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। সরে এসেছিলেন ব্রিজের ধার থেকে। তাঁকে যে লড়াই করতে হবে।
তার মাস দেড়েক আগেই তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সেনেটর পদে। ঘরজুড়ে খুশির জোয়ার। স্বপ্নপূরণের স্বাদ। তার মধ্যে বড়োদিনের প্রস্তুতি। দুই পুত্র, কন্যাকে নিয়ে তাই উৎসবের কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন বাইডেনপত্নী। বাড়ি ফিরেই আনন্দ মেখে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজের অফিসে থাকাকালীনই এসেছিল খবরটা। জানতে পেরেছিলেন, একটা ট্রাক পিষে দিয়ে চলে গেছে তাঁর স্ত্রীর গাড়িকে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন তিনি। সঙ্গে ফুটফুটে শিশুকন্যা। দুই পুত্রও হাসপাতালে লড়াই করছে জীবনের সঙ্গে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন আশা প্রায় নেই বললেই চলে।
এভাবেই ট্র্যাজিডি নেমে এসেছিল তাঁর জীবনে। সাজানো সংসার হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল তাসের ঘরের মতো। খুব কম দিনের সম্পর্ক নয় যে। আলাপ হয়েছিল ডেলাওয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার সময়ই। ১৯৬১ সালে। নেলিয়া হান্টারকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাইডেন। বছর পাঁচেক পরে ১৯৬৬ সালে বিবাহ। স্ত্রীকে প্রায়শই বলতেন নিজের স্বপ্নের কথা। একদিন সফল রাষ্ট্রনেতা হবেন তিনি। আমেরিকানদের স্বপ্নের জননেতা। সেই স্বপ্নপূরণ হওয়ার পরেই এমন একটা আঘাত সহ্য করা কতটা কঠিন তা ধারণার বাইরে।
মৃত্যুর সামনে থেকে ফিরে এসে, শুরু হল লড়াই। একদিকে প্রশাসনিক দায়িত্ব। অন্যদিকে সন্তানদের মানুষ করে তোলার চ্যালেঞ্জ। দুইয়ের যাঁতাকলে কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছিলেন জো বাইডেন। অফিসের অমানসিক কাজ সামলেও ফেরার সময় ঘুমিয়ে পড়তেন না ট্রেনে। বাড়ি ফিরে যে ঘুম পাড়াতে হবে সন্তানদের। ফিরতি পথে ক্লান্ত চোখ পড়ে নিত ‘ঘুমপাড়ানি গান’-এর নানান বই, গল্প, ছড়া। ফিরে গৃহস্থের সমস্ত কাজও করতে হত নিজে হাতেই। তবু হাল ছাড়েননি বাইডেন। কখনো কখনো হতাশা গ্রাস করত ঠিকই। কোনোদিন অ্যালকোহল স্পর্শ না করা জো বাইডেনও তাই মাঝে মাঝে রান্না ঘরে গিয়ে গ্লাসে ঢেলে নিতেন আগ্নেয় তরল। কখনো তাঁকে এসে সময় এসে বাধা দিয়েছে পুত্রসন্তান বিউ। কখনো নিজেই সরে এসেছেন সেখান থেকে। বাবার এই আচরণ দেখে যদি সন্তানরা বিপথে চলে যায়?
সন্তানদের মানুষ করতে পেরেছিলেন তিনি। বিউ বড়ো হয়ে অংশ নিলেন সেনাবাহিনীতে। সেখান থেকে ফিরে এসে হাঁটলেন বাবার পথেই। রাজনীতিতে। অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তারপর আরও একবার ট্র্যাজেডির ছায়া নেমে এসেছিল জো বাইডেনের বাড়িতে। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতি। বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন তাঁর সন্তান বিউ। রিপোর্ট আসতেই যেন অন্ধকার করে এল দু’চোখে। ক্যানসার। বিউয়ের মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ। ২০১৫-তে আরও একটা বিচ্ছেদ। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা। মৃত্যুশয্যায় থাকা বিউয়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শত প্রতিকূলতাতেও পিছিয়ে আসবেন না তিনি। নিজের সততা বজায় রেখেই লড়ে যাবেন রাজনৈতিক লড়াই। ছেলেকে দেওয়া সেই কথা রাখতেই হয়তো রাষ্ট্রপতির দৌড়ে আজ জো বাইডেনের নাম। কারণ, বছর পাঁচেক আগে তো তিনি ভেবেইছিলেন সরে যাবেন সবকিছু থেকে। নিজের সবথেকে কাছে মানুষ প্রিয় পুত্রের মৃত্যু টলিয়ে দিয়েছিল তাঁকে।
আরও পড়ুন
ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়ার মুখে বাইডেন, জেনে নিন আমেরিকা নির্বাচনের খুঁটিনাটি
তবে এই ধরণের প্রতিবন্ধকতাকে ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গে নিয়ে বড়ো হয়েছেন বাইডেন। দারিদ্র্য ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। বাবা ছিলেন পেনসিলভেনিয়ার সামান্য একজন সেলসম্যান। তা নিয়ে তো হাসি ঠাট্টা চলতই স্কুলে। অন্যদিকে কথা বলতেও সমস্যা ছিল কিশোর বাইডেনের। বারবার স্ট্যামারিংয়ে আটকে যাওয়া বাইডেন বুলির শিকার হতেন নিত্যদিন। তবে এসবের মধ্যেও তাঁকে চিরকাল মানসিক দৃঢ়তা যুগিয়েছিলেন তাঁর বাবা। বুনে দিয়েছিলেন সুদিন নিয়ে আসার স্বপ্নের বীজ।
সেদিনের কথা বলতে না পারা সেই কিশোরের বক্তৃতাতেই আজ মুগ্ধ মার্কিনিরা। ট্র্যাজেডির শিকার হওয়া সেই যুবকের ওপরেই ভরসা রাখছেন অধিকাংশ আমেরিকান। বাইডেনের ব্যক্তিগত জীবন এক অনন্য অনুপ্রেরণা যেন। ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের এক না বলা উপাখ্যান। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পরের কথা। জীবনের লড়াইয়ে অনেক আগেই জিতে গেছেন জো বাইডেন...
তথ্য ঋণ -
আরও পড়ুন
ফিদেল কাস্ত্রোকেও সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট? কেনেডি হত্যা-রহস্যের কিনারা হয়নি আজও
১. Biden says he thought about suicide after 1972 death of his wife and daughter, Max Cohen, Politico
২. Family of Joe Biden, Wikipedia
৩. Beau Biden, Vice President Joe Biden’s Son, Dies at 46, Michael D. Shear, The NY Times
Powered by Froala Editor