ফুলশয্যার রাতে, স্ত্রী’র কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চাইলেন তরুণ জীবনানন্দ

বিয়ের মুহূর্ত। বরিশালের দাশগুপ্ত বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হবে। কনের নাম লাবণ্য। বিয়ে তো হল, কিন্তু কিছুই তো দেওয়া হল না ছেলেকে। ঘড়ি, বাড়ি, গয়না, আসবাব— কিচ্ছু না। শুধু একটি আংটি। না, ছেলেটি এতটুকুও রাগ করেনি। বরং ওই আংটি পাওয়ার জন্যও ছিল প্রবল কুণ্ঠাবোধ। এরকম জানা থাকলে, সে তো নিজেই এটা কিনে নিয়ে যেতে পারত। আর বিয়েতে এসব দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারই বা কেন থাকবে! লাবণ্য অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর এমন কথা শুনে…

এমনই ছিলেন মানুষ জীবনানন্দ দাশ। কুণ্ঠিত, গুটিয়ে থাকা একজন মানুষ; অথচ দৃঢ়। পোশাক আশাকের প্রতি খুব একটা যত্ন থাকত না তাঁর। পরতেন মিলের মোটা ধুতি। একবার একটা ভালো ধুতি কিনে এনেছিলেন স্ত্রী লাবণ্য দাশ। কথায় কথায় বলেছিলেন, একটু ফিটফাট হয়ে, সাজগোজ করে থাকতে। নাহলে লোকে কী বলবে! তখন কিছু একটা লিখছিলেন জীবনানন্দ। লেখা থামিয়ে চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। রাগলেনও না, কিছুই করলেন না। শুধু শান্ত, ধীর গলায় বললেন- “তুমি যে ভাবে খুশি সাজ-পোশাক কর, তোমার সে ইচ্ছেয় আমি কোনদিনই বাধা দেব না। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে তোমার ইচ্ছামত চালাতে বৃথা চেষ্টা করো না।” রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন লাবণ্য। তারপর থেকে আর কখনও এমনটা বলেননি।

তাঁর বিয়ের ফুলশয্যার একটি ঘটনা বেশ কিছু লেখায়, স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে। জীবনানন্দ ও লাবণ্য— কেউই সেভাবে আগে কথা বলেননি। ফুলশয্যার রাতে জীবনানন্দের মুখ থেকেই বেরোল প্রথম কথা। বলা ভালো, অনুরোধ। একটি গানের। কোন গান? জীবনানন্দ বললেন, “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে”। ফুলশয্যার দিন, নববধূকে এমন অনুরোধ আগে কি কেউ করেছে? তাও একবার নয়, দু-দু’বার। অনেক পরে লাবণ্য এর কারণ জিজ্ঞেস করায় জীবনানন্দ দেখিয়ে দিয়েছিলেন গানটির দুটো লাইন -

“আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া।”

সমস্তটা চুপ হয়ে গেলে, কবি জীবনানন্দ দাশের গলা বেজে উঠল, “জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এমন গান গাওয়া উচিত”…

অন্যের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কখনও মাথা গলাতেন না তিনি। তাঁর সামনে কেউ সেটা করুক, তেমনটাও চাইতেন না। জীবনানন্দের মতে, “বড় হয়ে যে যেটা উচিত বলে মনে করবে সে সেটাই করবে। কারো তাতে বাধা দেওয়া ঠিক নয়।” লাবণ্য দাশ একসময় জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার আন্দোলনে। অবশ্য সময়টাও ছিল সেইরকমই। যাই হোক, যথারীতি তিনি পুলিশের নজরে পড়েন। সেই সূত্রেই সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে হাজির হন অফিসাররা। সেই ‘সার্চ’-এর জন্য গোটা ঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড। জীবনানন্দের প্রাণাধিক প্রিয় কবিতার খাতাগুলোও অক্ষত ছিল না। শেষে ঘর থেকে পাওয়া যায় আয়ারল্যান্ড বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে একটি বই। যে জীবনানন্দকে মুখচোরা বলে জানত সবাই, সে-ই তিনিই পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন একের পর এক প্রশ্নের। বইটি যে বি এ ক্লাসের ইতিহাসের রেফারেন্স বই, সেই কথাটাই বারবার বলছিলেন তিনি। পরে অন্যরা লাবণ্যের প্রতি বিরক্ত হলেও, জীবনানন্দ কখনও বিরক্ত হননি। বরং দেশের স্বাধীনতার জন্য চিন্তা করেন বলে অত্যন্ত গর্ব হয়েছিল তাঁর।

সেদিনের সেই অফিসারদের মধ্যে একজন অবশ্য চিনতে পেরেছিলেন কবি জীবনানন্দকে। যখন গোটা ঘরে তল্লাশি চলছিল, তখন তাঁর হাতে উঠে এসেছিল ‘ঝরাপালক’। পরের দিকে এইরকম আরও ছেলেমেয়ে তাঁর কবিতার কাছে এসে বসে থাকত। ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি ভরে উঠত তাঁদের নিয়ে। কাউকে নিরাশ করতেন না তিনি। এরাই যে তাঁর ‘ভবিষ্যতের আশা ভরসা’!

একবার একটি জায়গায় কবিতা পাঠে যাওয়ার কথা জীবনানন্দ দাশের। কিন্তু শরীরটা বেশ খারাপ। খবর পাঠালেন সজনীকান্ত দাসকে। সেই সজনীকান্ত, যিনি জীবনানন্দের কবিতার সমালোচনা করে ব্যঙ্গার্থক লেখায় ভরিয়েছেন ‘শনিবারের চিঠি’। তাঁকে অনুরোধ করলেন যাতে প্রথমেই তাঁর কবিতা পাঠ সেরে নেওয়া যায়। শুরুতে যেন চটে গেলেন সজনীকান্ত - “আপনি তো বেশ লোক মশাই। আপনাকে প্রথমদিকে আবৃত্তি করতে দিয়ে শেষে আমি চেয়ার বেঞ্চ নিয়ে বসে থাকি।” পরে অবশ্য হেসে জানান, তাঁর কবিতা শোনার পর ছাত্রদের আর সভায় আটকে রাখা যাবে না। তাই, একটু কষ্ট করে হলেও, তাঁকে থাকতে হবে। তিনিই যে তখন ভরসা…

ঋণ- মানুষ জীবনানন্দ/ লাবণ্য দাশ

Powered by Froala Editor

More From Author See More