বিনা-চিকিৎসাতেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ঝুমুরশিল্পী গান্ধীরাম মাহাতো

তাঁর গলায় খেলা করত ঝুমুরের সুর। কণ্ঠস্থ ছিল পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির ইতিহাস। বলরামপুর বাগানবাড়িকে পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক চর্চার পীঠস্থান করে তুলেছিলেন তিনি। গান্ধীরাম মাহাতো। সকলের কাছে অবশ্য তিনি পরিচিত ‘গান্ধীদা’ নামেই। গত পরশু না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন মানভূমের অন্যতম সেরা এই ঝুমুর শিল্পী।

বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই মধুমেহ রোগে ভুগছিলেন তিনি। উচ্চ শর্করা মাত্রার জেরে ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল শারীরিক অবস্থার। ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালেও। খানিক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ভেঙে গিয়েছিল স্বাস্থ্য। বিছানা ছেড়েও উঠতে পারতেন না কিংবদন্তি ঝুমুর শিল্পী। কয়েকদিন আগে পুনরায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ভর্তি করা হয় পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে। উচ্চ চিকিৎসার জন্য তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অর্থ কই? সরকারের কাছে দ্বারস্থ হয়েও সেভাবে কোনো সাহায্য পেলেন না তাঁর পরিবারও। একপ্রকার বিনা চিকিৎসাতেই চলে গেলেন গান্ধীরাম মাহাতো। বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৫ বছর।

আজীবন বলরামপুরে জীবন কাটালেও, গান্ধীরাম মাহাতোর জন্ম বাঘমুণ্ডির উকাদা গ্রামে। স্থানীয় বুর্দা হাইস্কুল থেকে পড়াশোনা করেন গান্ধীরাম। পরবর্তীতে স্নাতকতা করেন পুরুলিয়ার জগন্নাথ কিশোর কলেজ থেকে। তৎকালীন সময়ে উচ্চশিক্ষিত হয়েও কোনো চাকরি না পেয়ে তিনি চলে এসেছিলেন বলরামপুরের চিকিৎসক সুখেন্দু বিশ্বাসের কাছে। স্কুলজীবন থেকেই ফুটবলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল গান্ধীরামের। বলরামপুরে এসে শুরু হল পেশাগত ফুটবল খেলা। পুরুলিয়ার রয়্যাল ক্লাব তখন মধ্য গগনে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ফুটবল প্রতিযোগিতা তো বটেই এমনকি নেপালের মাঠেও ফুল ফুটিয়ে এসেছিলেন গান্ধীরাম। এনে দিয়েছিলেন একাধিক কাপ।

খেলার পাশাপাশি সমান তালেই চলত তাঁর ঝুমুরসাধনা। কিংবদন্তি ঝুমুর শিল্পী সলাবত মাহাতোর থেকে তালিম নিয়েছিলেন গান্ধীরাম। ঝুমুর সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ সেই সুখেন ডাক্তারের দৌলতেই। তৎকালীন সময়ে পুরুলিয়ার লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমি তৈরি করেন সুখেন্দু বিশ্বাস। এই সংগঠনের একেবারের জন্মলগ্ন থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন গান্ধীরাম। সেখানেই তিনি পরিচালকের দায়িত্ব সামলেছেন আজীবন।

আরও পড়ুন
দুই সহস্রাধিক গাছের অভিভাবক তিনি, বার্ধক্যও দমাতে পারেনি পুরুলিয়ার দুখু মাঝি-কে

রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমিতে তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছে বহু বহু লোকসঙ্গীত শিল্পী। ঝুমুর, ভাদু, করম, অহিরা ইত্যাদি একাধিক সঙ্গীত ঘরানার তালিম দিতেন গান্ধীরাম। সিধু-কানহু বিশ্ববিদ্যালয়েও ঝুমুরের ডিপ্লোমা বিভাগে কিছুদিন অতিথি অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছেন। তাছাড়াও তাঁর কাছে ছুটে আসতেন বাংলা সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লোকশিল্প গবেষকরা। তাঁদের নিজের কাছে রেখেই সঙ্গীতের পাঠ দিতেন অকৃতদার মানুষটি। গবেষক সোহম দাস জানালেন, “পুরুলিয়ায় অভিভাবক হিসাবেই পেয়েছিলাম গান্ধীদাকে। আমরা যে ঝুমুর গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত, সেগুলো আসল সুর কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সুরে অদ্ভুত একটা টান রয়েছে। গান্ধীদার কাছ থেকেই সেই সুরের সন্ধান পেয়েছিলাম। বহু গান গান্ধীদা নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন আমার খাতায়।”

আরও পড়ুন
গবাদি পশুকে আত্মরক্ষা শেখানোর কৌশল মিশে পুরুলিয়ার ‘কাড়াখুঁটা’য়

পুরুলিয়ার আরেক গবেষক ডঃ জলধর কর্মকারের কথাতেও ফুটে উঠল সেই কথাই, “পাতকুমকে পঞ্চকোটির দেশ বলা হয়। মানভূমিয়া, বরাভূমিয়া, শিখরভূমিয়া— প্রতিটা জায়গায় ঝুমুরের আলাদা আলাদা সুর আছে। বাঘমুণ্ডির সেই পাতকুমেই জন্ম গান্ধীদার। তাই ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিরায় শিরায় বইত এইসব ঘরানার সুর-স্বর।”

আরও পড়ুন
হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই; বাংলার দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনেই জন্ম পুরুলিয়ার

তবে এমন একজন ব্যক্তিত্বর ব্যক্তিগত সঞ্চয় বলে ছিল না কিছুই। টাকা-পয়সার পিছনে যে তিনি দৌড়ননি কোনোদিনই। বরং, মাটির গন্ধ আর সুরকে আঁকড়েই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। সরকারের থেকে সামান্য যা শিল্পীভাতা পেতেন, তা দিয়েই পেট চলত এহেন শিল্পীর। শেষ বয়সে চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যের আবেদন করেও ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। গান্ধীরাম মাহাতোর শিষ্য তথা গবেষক জলধর কর্মকার দুঃখের সঙ্গেই জানালেন সেই কথা, “শিল্পীদের গলায় যতক্ষণ সুর-স্বর ততক্ষণই তাঁরা হাততালি পান, তারপর আর কেউ ফিরেও তাকায় না।”

গত এপ্রিলে প্রয়াত হয়েছিলেন রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমির কর্ণধার ডাঃ সুখেন্দু বিশ্বাস। সেই শোকটাই আর শেষ বয়সে যেন মেনে নিতে পারলেন না গান্ধীরাম। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তিনিও যেন পাড়ি দিলেন সেই অদৃষ্টের দিকেই। এমন একজন অভিভাবক-সম ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা মানভূম। শেষ হল ঝুমুরচর্চার একটি দীর্ঘ অধ্যায়…

ছবি ও তথ্যঋণ- জলধর কর্মকার, সোহম দাস

Powered by Froala Editor