হাজারিবাগের অরণ্যে ঘেরা বিস্তীর্ণ জমি নিয়ে বুলু ইমামের বাড়ি। আর সেই বাড়িতে বসেই আদিবাসী জীবনের চিরাচরিত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন একদল মহিলা। ৭৯ বছরের বুলুর বাড়িতে বসেই সোহরাই এবং খোবার ধারার ছবিকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে গত ৩০ বছর ধরে। আর এই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন ট্রাইবাল উইমেন কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠনও। আদিবাসী মহিলারা (Tribal Women) বাড়ির দেয়ালে যে ছবি আঁকেন, তার ইতিহাস অতি প্রাচীন। আর সেই ইতিহাসের ঐতিহ্যকে (Tradition) ধরে রাখতেই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিলেন বুলু।
ইতিহাস বা ছবি, কোনোটার প্রতিই অবশ্য ছোটো থেকে কোনো আকর্ষণ ছিল না বুলুর। হাজারিবাগের অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। পরিবারের বাকিদের মতোই প্রথম জীবনে রাজনীতির মঞ্চে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। আর ছিল শিকারের নেশা। যদিও নিছক মনোরঞ্জনের জন্য শিকার করতেন না বুলু। বরং কোনো হিংস্র জন্তু মানুষের ক্ষতি করলে তবেই বন্দুক তুলে নিতেন তিনি। এভাবেই জীবনের শুরুটা কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। এমন সময় ’৮০-র দশকে শুরু হল কয়লা খননের কাজ। বুলু খবর পেলেন, কয়লা খনির জন্য প্রায় ৩ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হবে। সেই থেকে খনি-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুললেন তিনি।
এই আন্দোলনের সূত্রেই একদিন এক জেসুইট ধর্মযাজকের সূত্রে বুলু জানতে পারলেন হাজারিবাগের কাছে একটি কয়লাখনিতে একটি গুহা পাওয়া গিয়েছে, আর সেই গুহার দেয়ালে লাল রং দিয়ে আঁকা রয়েছে একটি রেখাচিত্র। প্রত্নতাত্ত্বিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুলু পৌঁছে যান সেখানে। আর জানতে পারেন, এই রেখাচিত্রটি প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষের আঁকা। তার বয়স কম করে ১০ হাজার বছর। তবে বুলুর আরও আশ্চর্য লেগেছিল, এই ছবির সঙ্গে আদিবাসী মহিলাদের বাড়ির দেয়ালে আঁকা ছবির অদ্ভুত সাদৃশ্য।
১৯৯১ সাল থেকে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাচীন প্রত্নচিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন বুলু। আর সেইসঙ্গে শুরু হয় তাঁর নিজস্ব গবেষণা। বুলু বুঝতে পারেন, প্রস্তরযুগ থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সোহরাই ও খোবার গোত্রের ছবি আঁকার পদ্ধতি। আদিবাসী জনজীবনের অন্যতম উপাদান এই ছবিগুলি। এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। সেইসঙ্গে তাকে যুগোপযোগী করে তোলাও প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শিল্পীর আঁকা ছবির ‘প্রদর্শনী’ চাঁদে
’৯০-এর দশকেই তিনি গড়ে তুললেন আদিবাসী মহিলা শিল্পীদের সংগঠন। এখন তার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। ২৮টি আন্তর্জাতিক এবং অসংখ্য জাতীয় স্তরের প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে তাঁদের আঁকা ছবি। ইতিহাস সংরক্ষণের এই প্রচেষ্টার জন্য বুলু ইমামও বহু সম্মান পেয়েছেন। ২০১১ সালে লন্ডনের গান্ধী ফাউন্ডেশন থেকে শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। সরকারের তরফ থেকেও তাঁর কাজকে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। তবে বুলু ইমাম মনে করেন, প্রশাসনিক বিধি দিয়ে আদিবাসী সংস্কৃতিকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। বরং সামাজিক উদ্যোগই পারে এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
আরও পড়ুন
মেক্সিকোর বুকে শিল্প-শহর, ৮০ বছর পর বাস্তবায়িত হল দিয়েগো রিভেরার স্বপ্ন
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শিল্পপতিদের ঠেকাতে গোটা গ্রামকেই রঙে মুড়েছেন তাইওয়ানের বৃদ্ধ