ঝাড়খণ্ডের অরণ্যের রক্ষাকর্তা ‘জঙ্গল কা শেরনি’

পিঠে তীর-ধনুক। হাতে লাঠি। কোমরে ঝোলানে শাণিত ছোরা। এমন অস্ত্রসজ্জিত হয়েই জঙ্গলের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একদল মহিলা। ঝাড়খণ্ডের সরকাঘাট গ্রামের লাগোয়া অরণ্যে এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় প্রতিদিনই। তবে কি শিকারে বেরিয়েছেন তাঁরা? না, বিষয়টা তেমন নয়। আদতে ওঁরা এই জঙ্গলের রক্ষাকর্তা। অভিভাবকও বটে। মানুষের হাত থেকে অরণ্যনিধন ঠেকাতেই এমন উদ্যোগ সরকাঘাটের (Sarkaghat) মহিলাদের। 

২০১১ সাল। জামশেদপুর পুলিশের মহিলা কনস্টেবল কান্দনি সোরেনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এই অরণ্য-সুরক্ষা অভিযান। ক্রমে অরণ্য পাহাড়া দেওয়া এই গ্রামের মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আর কানন্দির পরিচয় হয়ে উঠেছে ‘জঙ্গল কি শেরনি’ (Jungle Ki Sherni)। 

সরকাঘাটের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা নির্ভর করে মূলত অরণ্যের উপরেই। তবে শুকনো কাঠ, পাতা এবং অরণ্যের অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করলেও, জীবিত গাছ কাটেন না তাঁরা। প্রাচীন জনগোষ্ঠীর এইসব মানুষদের কাছে অরণ্য অত্যন্ত পবিত্র অঞ্চল। কিন্তু বিগত দু’দশক ধরে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে চোরাশিকারি এবং মাফিয়াদেরদের উপদ্রব। পশুশিকার থেকে শুরু করে, অবৈধভাবে গাছ কাটা এমনকি চাষের জমি অধিগ্রহণ— এইসকল ঘটনা লেগেই রয়েছে সরকাঘাটের অরণ্যে। আর প্রশাসন? প্রশাসন কি কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এই অরাজকতার বিরুদ্ধে? 

না, তেমন নয়। স্থানীয় পুলিশ রীতিমতো টহলদারি চালায় সরকাহাট সংলগ্ন অঞ্চলে। তবে ২৫০ একর অরণ্যের গভীর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের হদিশ পাওয়া বেশ কঠিন। জঙ্গলের কেন্দ্রে প্রবেশ না করলে তা টের পাওয়াই দায়। ফলে, অরণ্যের স্বার্থে বিকল্প পথের অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন কান্দনি সোরেন। অরণ্যরক্ষার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। গ্রামের মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সেনাবাহিনী’। শুরুতে ‘হরিয়ালি সাকাম’-খ্যাত সেই দলের সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। বর্তমানে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। ৪টি দলে ভাগ হয়ে ৬ ঘণ্টা করে অরণ্য পাহারা দেন তাঁরা। অর্থাৎ, ২৪ ঘণ্টাই টহলদারি চলে অরণ্যের মধ্যে। পুলিশের সেরে প্রতিদিন রাতে অরণ্য পাহাড়া দেন কান্দনি নিজেও। 

আরও পড়ুন
চার শতক পেরিয়ে অরণ্যের অধিকার ফিরে পেলেন ভার্জিনিয়ার ভূমিপুত্ররা

তবে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন না ‘হরিয়ালি সাকাম’-এর সদস্যরা। মানুষকে আহত করাও উদ্দেশ্য নয় তাঁদের। অস্ত্রসজ্জা কেবলমাত্র ভয় দেখানো এবং আত্মরক্ষার জন্যই। অরণ্যে কোনো অবৈধ ঘটনার হদিশ পেলে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফোনের মাধ্যমে স্থানীয় থানায় খবর পৌঁছে দেন অরণ্যের রক্ষাকর্তারা। পুলিশ এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত অপরাধীদের আটকে রাখেন তাঁরা। কান্দনির এই উদ্যোগে আশ্চর্যজনকভাবেই চোরাশিকার এবং অবৈধ অরণ্যনিধন কমেছে ঝাড়খণ্ডের এই অরণ্যে। কমেছে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। এভাবেই যেন একটু একটু করে বদলের প্রহর গুনছে সরকাঘাট…

আরও পড়ুন
অরণ্যের থেকেও বেশি কার্বন শোষণ করে ‘শহুরে’ গাছ! জানাচ্ছে গবেষণা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
৪০ বছর ধরে ম্যানগ্রোভ অরণ্য বাঁচানোর লড়াই কেরালার মৎস্যজীবীর