১৯৮৩ সাল। ২ ফেব্রুয়ারি। অ্যারিজোনার হাসপাতালে ভূমিষ্ঠ হল একটি কন্যা সন্তান। তবে উচ্ছ্বাসে বদলে সেদিন খানিকটা মলিন হয়ে গিয়েছিল কক্স দম্পতির হাসি। কারণ সদ্যজাতের শরীরে নেই দুটি হাতই। চিকিৎসকরা জানান, মাতৃত্বকালীন কোনো জটিলতা থাকার দরুন সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি ভ্রূণ। হতাশা ছিলই, তবে কক্স দম্পতি সেদিন ঠিক করেছিলেন এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আর পাঁচ জনের থেকে মতোই স্বাভাবিকভাবে মানুষ করবেন তাঁদের সন্তানকে। সেদিনের সেই প্রতিজ্ঞা থেকে বিন্দুমাত্রও সরেননি তাঁরা। আর অদম্য জেদের ওপর ভর করে সব প্রতিকূলতা জয় করেছে তাঁদের সন্তান, জেসিকা কক্স। পৃথিবীর প্রথম হাতহীন পাইলট তিনিই।
তবে লড়াইটা যে কতটা কঠিন ছিল তা না বললেও চলে। বয়স তখন ৩ বছর। স্কুলে ভর্তি হবেন জেসিকা। তবে বাবা ঠিক করেছিলেন সাধারণ কোনো স্কুলেই ভর্তি করবেন জেসিকাকে। সেইসময়ই প্রস্থেটিক্সের হাত লাগানো হয় জেসিকার। তবে সে হাতের ব্যবহার ছিল না কোনো। পায়ের পাতা দিয়েই হাতের কাজ সারতেন তিনি। লেখা থেকে শুরু করে ছবি আঁকা, সব কিছুই পা দিয়ে। ১১ বছর বয়সে তাই সেই হাত নিজেই খুলে ফেললেন তিনি।
স্কুলে গিয়ে দূর থেকেই দেখতেন বন্ধুরা খেলা করছে মাঙ্কিবারে, চড়ছে দোলনা। অথচ শৈশবের এইসব অধ্যায় ব্রাত্য তাঁর জীবন থেকে। তার মধ্যেই ভেসে আসত বন্ধুদের থেকে হেঁয়ালি করা কথা। মানসিকভাবে সেই আঘাত ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী করে তুলত জেসিকাকে। করে তুলত আরও জেদি।
অনেকটা সেই জেদের বশেই শুরু হয়েছিল লড়াই। প্রথমে ট্যাপ ড্যান্সিং শেখা। তারপর নাম লেখানো মার্শাল আর্টের খাতায়। অবাক লাগছে? হ্যাঁ, ঠিকই বলছি মার্শাল আর্ট। তাইকোন্ডুতে তৃতীয় পর্যায়ের ব্ল্যাকবেল্ট অধিকারিণী হয়েছিলেন অ্যারিজোনার বাসিন্দা। পা দিয়ে অনায়াসেই চালাতে পারেন নানচাক।
শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে পিয়ানো-বাদন, স্কুল-কলেজে পড়ার সময় সবটাই শিখেছেন জেসিকা। শুধু বাকি ছিল একটা স্বপ্নপূরণ। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকেই জেসিকা ভেবে এসেছিলেন একদিন উড়ান দেবেন ককপিটে বসে। তবে বড়ো হয়ে জেসিকা বুঝতে পারেন তাঁর রয়েছে অ্যাক্রোফোবিয়া। উচ্চতায় উঠলে তাঁকে আঁকড়ে ধরে আতঙ্ক।
তবে নিজে প্রাথমিকভাবে পিছিয়ে এলেও তাঁর সেই স্বপ্নের কথা মনে রেখেছিলেন তাঁর বাবা। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই উড়ানের ভয়কে ইতিবাচক দিকে পরিণত করার লড়াই শুরু হয় জেসিকার। স্নাতকতা শেষ করার পর ‘রাইট ফ্লাইট’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন জেসিকা। প্রাক্তন যুদ্ধবিমানচালক ও সংস্থার মালিক রবিন স্টেডার্ড এই অদম্য ইচ্ছা দেখে নিজেই দায়িত্ব নেন প্রশিক্ষণের। প্রাথমিক শিক্ষার পর ‘অ্যাবেল ফ্লাইট’ নামে আরও একটি সংস্থায় ভর্তি হন জেসিকা। সেখান থেকেই অর্জন শেষ অবধি বিমানচালকের পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর আদায় করে নেন পাইলট হওয়ার পূর্ণ লাইসেন্স।
আরও পড়ুন
চলে গেলেন লাপিয়ারের ‘সিটি অফ জয়’-এর অনুপ্রেরণা ফাদার ল্যাবোর্দি
তার তিন বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান চালক হিসাবে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান জেসিকা। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত ৩৭ বছরের এই মহিলা পাইলট। গিনেস বুকও তাঁর এই কৃতিত্বের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের অনুপ্রেরণা দিতে মাঝে মধ্যেই সভার আয়োজন করে থাকেন তিনি। এখনও পর্যন্ত ২৩টি দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন জেসিকা কক্স। অনুপ্রাণিত করেছেন হাজার হাজার মানুষকে। মনের জোর থাকলে যে সবকিছুই জয় করা সম্ভব, তারই উদাহরণ তিনি...
Powered by Froala Editor