ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী, শরৎ এসেছে অনেকদিন হল। শরৎকাল মানেই আপামর বাঙালির দিন গোনা শুরু। কারণ পশ্চিমবাংলা তথা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব তো এই শরৎেই। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন দুর্গাপূজা, আর মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি দিন, ইতিমধ্যেই গ্রাম-গঞ্জ-মহল্লা-শহর সর্বত্রই সাজো-সাজো রব উঠে গেছে। বাজার করা, বাড়ি গোছানো, মুড়ি-মুড়কি-খইয়ের নাড়ু, আরও কত আয়োজন। অপেক্ষায় বিহ্বল হয়ে কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সকলেই যখন একটা দুটো করে দিন গুনছেন, ঠিক সেইসময়ই বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মায়ের আগমনের অর্থাৎ বোধনের ঘণ্টাধ্বনিকে আরও উজ্জ্বল করতে, গত রবিবার হয়ে গেল আঞ্চলিক উৎসব ‘জিতাষ্টমী’। অর্থাৎ দুর্গাপূজার আগে আশ্বিনের উজ্জ্বল তিথিতে আরও একবার যে অষ্টমী আসে, সেই অষ্টমীর উদযাপনের মধ্য দিয়ে মায়ের বোধনের সূচনা। অনেকে আবার এই তিথিকে ‘কৃষ্ণা অষ্টমী’ও বলে থাকেন।
বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রামজুড়ে প্রচলিত এই রীতি অর্থাৎ জিতাষ্টমী যেন এক অনন্য দুর্গোৎসবের মহা-সূচনা। মূলত বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক স্তরের মানুষদের মধ্যে জাগরিত বহু প্রাচীন প্রথা ও রীতি হল 'জিতাষ্টমী'। যে রীতির মূল বার্তা হল মায়ের আগমন ও বোধনকে সংহতি জানানো। অর্থাৎ এই কৃষ্ণাষ্টমী বা জিতাষ্টমীর দ্বারাই যেন তাঁদের বিশ্বাসে মায়ের বোধন সম্পন্ন হয়।
আঞ্চলিক স্তরের এই অনুষ্ঠানের সমস্তরকম ক্রিয়াকলাপ খুব দৃষ্টিনন্দন হলেও সেই অঞ্চলের মানুষদের বিশ্বাসের কাছে এ-যেন এক কঠিন ব্রত। আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক কী সেই ব্রত, কীই বা তাঁদের রীতি।
জিতাষ্টমীর তিথিকে কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠান শুরু হয় মূলত মূল তিথির দু-দিন আগে। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির মা-বৌ-বোনেরা স্নান সেরে, শুদ্ধ কাপড়ে একটি শালপাতার ডালায় আতপ চাল, সিঁদুর, কলা, শসা, বেলপাতা ও একটি টিনের ছাতনায় ভিজে ছোলাকে শ্রদ্ধাভরে ঘরের পবিত্র জায়গায় রেখে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ করেন। এরপর পরদিন সকালে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বাড়ির প্রত্যেক মহিলা নির্জলা উপোস থেকে, গত সন্ধ্যায় তৈরি রাখা প্রসাদী থালাকে গ্রামের এক কোনো এক স্থানে পুজো-পাঠের জন্য রেখে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের ভাষায়, সেই ঈশ্বরকে ‘জীমূতবাহন’ বলা হয়। রাতে জিমূতবাহনের পুজো করে বাড়ি ফিরে আসেন প্রসাদ নিয়ে। তারপর বাড়ির বাচ্চা-বৃদ্ধ ও পুরুষদের মঙ্গল আসনে বসিয়ে কার্যত বরণ করেন। পাশাপাশি হাতে শালপাতার থালায় প্রসাদ তুলে দিয়ে পরিবারের মঙ্গলকামনা করেন মহিলারা।
ঠিক তারপরের দিন সেই বাড়ির মহিলারা আবারও নির্জলা উপোস থেকে, দিনের শেষে একটা সময়ে সকলে মিলে স্নান সেরে নিজেদের উপোস ভঙ্গ করতে ঘাটে যান। সঙ্গে যান পুরুষরাও। মহিলারা পুকুর বা নদীর জলে নেমে প্রত্যেকে একটা শসার আড়াই কামড় খেয়ে কার্যত ফলাহারের মধ্যে দিয়ে উপোস ভঙ্গ করেন তারপর স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র ধারণ করে নিজ-নিজ স্বামী-সন্তান সকলকে একসঙ্গে নিয়ে চিড়ে-মুড়ি-খই খান তাঁরা।
এখানেই শেষ নয়, খাওয়া দাওয়ার পর সেই মহিলারা আবার নদীতে স্নানে যান এবং ভেজা বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় প্রত্যেকে মঙ্গলঘটে নদী থেকে জল সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাড়িতে বা পুজোর মণ্ডপে সেই ঘট প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার বোধনের সূচনা হয়, এমনটাই বিশ্বাস তাঁদের।
সত্যিই এ যেন এক কঠোর ব্রত, এক প্রাচীন সংস্কৃতি। এর সঙ্গে মিশে আছে না জানি কত লোককথা, আচার ও ঐতিহ্য। একই সঙ্গে অপূর্ব বিশ্বাস যুগ-যুগান্ত ধরে সঞ্চারিত হয়ে আসছে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার মানুষের মধ্যে। এই বিশ্বাসই গ্রামবাংলার মূল স্পন্দন, বাংলার আসল চরিত্র।