"... So how did I learn to write? From listening to music. And what's the most important thing in writing? It's rythm."
'জুয়ান লে পঁ' কমিউনের (দক্ষিণ ফ্রান্সের অন্টিব শহরের অংশ) বাস-স্টপে কড়া রোদে বাসের অপেক্ষায় মিনিট কুড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েও বিশ্বখ্যাত জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির এই কথাগুলোই বার বার মনে হচ্ছিল আমার। আসলে লেখালেখির সঙ্গে সাঙ্গীতিক সৃজন-পদ্ধতির এই প্রভূত মিলের দিকটা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারলেও, মূলত মুরাকামিই আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। এহেন পাগলামো ঠাহর করেই বুঝি ঝকঝকে ফরাসি বৃদ্ধা তাঁর বাক্সবন্দি বেড়ালকে নিয়ে খানিকটা গজগজ করতে করতেই আমার পাশ থেকে সরে গিয়ে ফুটপাথের ধারেই বসে পড়লেন। অবশ্য দক্ষিণ ফ্রান্সের জ্বালাময়ী দাবদাহে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুরাকামি আওড়ানো যে সত্যিই পাগলামো, তা আপনাদেরও মনে হচ্ছে নিশ্চই? এখন প্রশ্ন হল, এই উন্মাদনার কারণ কী?
এসেছিলাম জুয়ান লে পঁ জ্যাজ উৎসবের প্রেস কার্ড সংগ্রহ করতে। বহুদিনের ইচ্ছা ছিল; শিকে ছিড়ল এই ২০২২-এর জুলাই মাসে। কার্ড নেওয়ার পর প্রেস অফিসে লুসি আর ক্লেমঁ-দের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে ভূমধ্যসাগর-পারের মূল ওপেন-এয়ার প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে তো চক্ষু চড়কগাছ! এ কী দেখছি? ৬১ বছর বয়সী ফেস্টিভ্যালের আজকের সান্ধ্য আয়োজন যাঁকে নিয়ে, সেই পৃথিবী কাঁপানো ‘হ্যামন্ড অর্গান’-বাদক ম্যাডাম রোডা স্কট স্টেজ হিহার্সাল দিচ্ছেন; চলছে আজকের কনসার্টের সাউন্ড টেস্টিং। শুধু তাই নয়, স্টেজে উপস্থিত রোডার গানের দল ‘লেডিজ অল স্টার’-এর তাবড় তারকারাও। এ দৃশ্য সত্যিই স্বপ্নাতীত। এই ঐতিহাসিক সঙ্গীত উৎসবে সেই ১৯৭৫ সালে শেষবার পারফর্ম করেছিলেন রোডা। আবার এই ২০২২-এ।
আরও পড়ুন
দেশে নিষিদ্ধ সঙ্গীত, গৃহবন্দি হয়েও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আফগান শিল্পীরা
আরও পড়ুন
কবিপক্ষের কলকাতা ও একটি সঙ্গীতসন্ধ্যা
‘জ্যাজ-আ-জুয়ান’(JazzAJuan) বা জুয়ান লে পঁ জ্যাজ ফেস্টিভালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে কথা হচ্ছিল প্রখ্যাত তবলিয়া তথা সঙ্গীত শিল্পী নীহার মেহতা(Nihar Meheta)-র সঙ্গে। আহমেদাবাদের প্রখ্যাত মেহতা পরিবারের ছেলে (ভারতের অন্যতম সঙ্গীত আকাদেমি 'সপ্তক মিউজিক স্কুল' ওঁর কাকা নন্দন মেহতার হাতের তৈরি) নীহার ২০০২ সাল থেকেই দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস শহরের কাছেই থাকেন এবং ইউরোপের অন্যতম তবলিয়াদের একজন। এছাড়াও উস্তাদ জাকির হুসেনের যাবতীয় ইউরোপীয় কনসার্টের দায়িত্বে রয়েছেন নীহার। পণ্ডিত কিষেন মহারাজ এবং পরবর্তী সময়ে পুরান মহারাজের ছাত্র নীহারের নিজের কথায়, "১৯৬০ সালে তৈরি জ্যাজ-আ-জুয়ান উৎসব আসলে এই এলাকার বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের (সিডনি বেচেত প্রমুখ) উৎসর্গ করে শুরু হয়েছিল। এই ফেস্টিভালের হাত ধরেই ধীরে ধীরে জ্যাজ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।" এও বলে রাখা জরুরি যে, ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া সুইজারল্যান্ডের প্রখ্যাত 'মন্ত্রু জ্যাজ ফেস্টিভাল'-এর প্রবক্তা ক্লড নবজ একবার বলেছিলেন— “If I hadn't passed through Antibes, Montreux wouldn't exist." বিশ্ব সঙ্গীতের আঙিনায় জুয়ান লে পঁ জ্যাজ উৎসব এমনই এক নক্ষত্র।
আরও পড়ুন
ইউক্রেন সীমান্তে পিয়ানোবাদন, শান্তির বার্তা জার্মান সঙ্গীতশিল্পীর
নীহার আরো জানালেন, “ফিউশান জঁরার অন্যতম ব্যান্ড 'শক্তি' এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই মূল ধারার ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি বলে বলতে পারি, জ্যাজ-আ-জুয়ানের মতো করে সঙ্গীতের এমন সাংস্কৃতিক মিশ্রণকে শুরুর দিকে প্রায় কোনো উৎসবই এতটা প্রাধান্য দেয়নি। এই জুয়ান লে পঁ-এর উৎসবেই প্রথমবার জন ম্যাকলাফলঁ, জাকির হুসেন এবং শক্তির হাত ধরে বিশ্ব সঙ্গীতের জন্য আমাদের দেশের দরজা চিরতরে খুলে যায়।"
প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সাল এবং ১৯৯৯ সালের (শক্তি) পর, দীর্ঘ ২৩ বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে এবার। প্রখ্যাত ব্রিটিশ 'ডবল বেসিস্ট' ডেভ হল্যান্ড এবং মার্কিনী স্যাক্সোফোন বাদক খ্রিস পটারকে সঙ্গী করে, তাদের ফিউশান ব্যান্ড 'ক্রস কারেন্ট ট্রিও' নিয়ে এ-বছরের জ্যাজ-এ-জুয়ানে উপস্থিত থাকছেন উস্তাদ জাকির হুসেন। ১৬ জুলাই সমুদ্র উপকূলের মূল ওপেন এয়ার প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হবে এই সান্ধ্য কনসার্ট। পৃথিবীখ্যাত তবলাবাদক এবং আমাদের নয়নের মণি জাকির কোন সাঙ্গীতিক মূর্ছনায় জুয়ান লে পঁ-র জ্যাজপ্রেমীদের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের জমে থাকা বিরহ-অভিমান তার শাশ্বত সঙ্গীত-প্রেমের বাঁধভাঙা আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যান, এখন শুধু সেটাই দেখার অপেক্ষা।
Powered by Froala Editor