চন্দ্রজয়ের নেপথ্যে উত্তরপাড়ার জয়ন্ত লাহার গবেষণাসমৃদ্ধ প্রজ্ঞানের নেভিগেশন ক্যামেরা

“প্রজ্ঞান রোভারের যে ক্যামেরাটা আছে, যাকে বলা যায় রোভারের চোখ। তার উপর নির্ভর করে ঘুরবে রোভারটি। দেখতে পাবে চাঁদের মাটিকে। দেখবে তার সামনে কোনো বাধা আছে কিনা কিংবা কোন দিকে এগোনো উচিত? সেই পুরো জিনিসটি, মানে ক্যামেরার নির্মাণে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে দাদা।”

খুব সহজ করে বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন সুমন্তবাবু। সুমন্তবাবু বর্তমানে ম্যানচেস্টারের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন হৃদপিণ্ডের ‘কার্ডিওভাসকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং’ নিয়ে। ২০২০-তে  গান্ধীয়ান ইয়ং টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন ২০২০-র সিটিআরএ (সিতারে) বিভাগে সম্মানিত হন তিনি।

তাঁর আরেকটি পরিচয়ও আছে। তিনি জয়ন্ত লাহার সহোদর। যিনি এই মুহূর্তে জড়িয়ে আছেন ইসরোর চন্দ্রযান ৩-এর সঙ্গে। ইতোমধ্যেই বিক্রম-এর সফল অবতরণ হয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠে। কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রজ্ঞান রোভার। সেখানেই উঠে আসে জয়ন্ত বাবুর নাম। চাঁদের মাটিতে রোভারের নেভিগেশন ক্যামেরার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁর। স্বাভাবিকভাবেই অবতরণের পর, আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জয়ন্তবাবু। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অজানা অংশে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে একের পর এক ছবি। চন্দ্রজয় করেছে ভারত, তাতে স্পর্শ রয়েছে উত্তরপাড়ার জয়ন্ত লাহারও।

তবে যাত্রাপথটা খুব একটা সহজ ছিল না। চন্দ্রযানের একাধিক মিশনের মতোই সাফল্য-ব্যর্থতায় ভরা জীবন। তাঁর জন্ম ১৯৮৭ সালে হুগলির উত্তরপাড়ায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে। তারপর পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্ট এন্ট্রান্সে র‍্যাঙ্ক করে আইআইইএসটি শিবপুরে ভর্তি। তখন অবশ্য নাম ছিল শিবপুর বি. ই কলেজ। ২০০৯ সালে সেখান থেকে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন নিয়ে বি. টেক পাশ করার পরে ঠিক করেন উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যাবেন। এম. টেকে ভর্তিও হন আইআইটি খড়গপুরে। 

ততদিনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন মহাকাশ নিয়ে গবেষণার। বাড়ির কাউকে কিছু না-জানিয়েই বসেছিলেন ‘ইসরো’-য় কর্মীনিয়োগ পরীক্ষায়। পেয়েও যান। অথচ এক অদ্ভুত দ্বিধা কাজ করতে থাকে তাঁর মধ্যে। একদিকে এম. টেক-এর উচ্চশিক্ষা, অন্যদিকে ‘ইসরো’-য় চাকরি। বলা ভালো মহাকাশকে হাতের মুঠোয় ধরার সুযোগ। শেষ পর্যন্ত বেছে নেন ইসরো-কেই। আড়াই মাসের মাথায় আইআইটি খড়গপুরের পড়াশোনায় অব্যাহতি দেন। আপাতত ১৩ বছর ধরে ‘ইসরো’-র বিভিন্ন বিভাগের গবেষণায় যুক্ত আছেন জয়ন্তবাবু।

২০১৯-এ অবশ্য চাকরি করাকালীনই খড়গপুরে এম. টেক-এর পড়াশোনা শুরু করেন। ততদিনে ঘোষিত হয়েছে ‘চন্দ্রযান ২’ মিশন। সেখানেও ক্যামেরা নেভিগেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁর। চন্দ্রযান উৎক্ষেপণের দিন গ্রহণ করেন ‘কন্ট্রোলিং’ অফিসের দায়িত্ব। কিন্তু সমগ্র ভারতবাসীর প্রার্থনা সত্ত্বেও আপাত ব্যর্থ হয় সেই মিশন। চাঁদের মাটিতে প্রজ্ঞান রোভার-এর অবতরণ সঠিকভাবে না হওয়ায় সুযোগ পাওয়া গেল না নেভিগেশন ক্যামেরা পরীক্ষার। জয়ন্তবাবু তো বটেই, হতাশায় ভেঙে পড়েন গোটা লাহা পরিবার। একটা বিরাট ধাক্কা তাঁদের নির্বাক করে দেয়।

সাময়িক হতাশা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন জয়ন্ত লাহা। খুব তাড়াতাড়ি আবার পুরো প্রকল্পকে সচল করে তুলতে হবে। সুমন্তবাবুকেও বলেছিলেন সে কথা। তাই গর্বের সঙ্গে তিনি বলছিলেন,

“আর সেটারই ফল আমরা দেখতে পেলাম চার বছরের মধ্যে। যার সাফল্য আজ আমাদের চোখের সামনে।”

সেই অধ্যাবসায়ের জেরেই চাঁদে ভারতের পতাকা নিয়ে ঘুরছে প্রজ্ঞান রোভার। আগামী ১৪ দিন ধরে নেভিগেশন ক্যামেরা কাজ করতে থাকবে। চাঁদের মাটিতে এঁকে দেবে অশোক স্তম্ভ। আনুষ্ঠানিকভাবে আরও অসংখ্য ছবি পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই।

গতকাল উৎসব ছিল সমগ্র ভারতের, উত্তরপাড়ার মানুষও মেতেছেন আনন্দে। আনন্দাশ্রু পরিবারের চোখে। সুমন্তবাবু জানান, “মায়ের আজকের খুব গর্বের দিন।” অনেক লড়াইয়ের পথ পার করে জয়ন্ত লাহার গবেষণা পাড়ি দিয়েছে বহু দূর। অসংখ্য সমস্যা আর দ্বিধায় যাঁর পথ রুদ্ধ হয়েছে বারবার, আজ তাঁরই কাজে লুকিয়ে আছে চন্দ্রজয়ের চাবিকাঠি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More