একই মঞ্চের একদিকে নামাজ, অন্যদিকে মন্ত্রপাঠ – সম্প্রীতির দৃশ্য বর্ধমানের যাত্রাপালায়

অভিনয় শিল্পের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা যাত্রাপালা। যাত্রা ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম লোকজ সংস্কৃতি। যাত্রা শুরুর ইতিহাস বিনোদনে মুখরিত হলেও, সময়ের সাথে সমাজের পথচলা যত বাঁক নিয়েছে, ততই রক্তাক্ত ও অত্যাচারিত হয়েছে যাত্রা। যাত্রা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এক অন্যতম জ্ঞাপন সংস্কৃতি ও লোকায়েত মাধ্যম। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে যাত্রার ইতিহাসে এত রক্তপাত ও নৃশংসতা কেন? যাত্রার সাথে শাসকের এত দ্বন্দ্ব কেন? উত্তরটা লুকিয়ে আছে যাত্রার ওই বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই। যেহেতু যাত্রা এক লোকায়ত মাধ্যম, তাই প্রান্তিক স্তরের গ্রামীণ মানুষের অন্যতম গলার স্বর বা আওয়াজ ছিলো যাত্রাপালা।

গ্রামের একদম নিরক্ষর, স্কুলে না যাওয়া হারু বাগদীও এর ব্যতিক্রম নয়। যাত্রাপালার মঞ্চের সামনে বসে বিচার করে সেও বুঝতে পারে, এ-সমাজে কোনটা শোষণ, কোনটা শাসন। কারাই বা শাসক আর কাদের জন্য হারু বাগদীরা দিনের পর দিন শোষিত, অত্যাচারিত ও বঞ্চিত। সেজন্যই ঘন হয়ে আসা আলো-আঁধারির মঞ্চে যখন যাত্রা পরিবেশিত হয়, তখন মঞ্চের সামনে অন্ধকারে বসে থাকা হারু বাগদীরা গর্জন করে ওঠে – ‘কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে, সে আমার রক্তে ধোয়া দিন।’

সেই 'হীরক রাজার দরবারে' দাঁড়িয়ে আমরা এক শাসকের মুখে শুনেছিলাম –‘ওরা যত বেশি শিখবে তত বেশি জানবে আর যত বেশি জানবে তত কম মানবে!’ ভারতের যাত্রাপালার ক্ষেত্রে শাসকের সমস্যাটি ঠিক এই জায়গায়। স্বাধীনতার আগে থেকেই, যাত্রাপালা গাঁয়ের নিরক্ষর বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষগুলোকে ঠিক ভুলের শিক্ষা দিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করে, উল্টে দিতে পারে শাসকের সিংহাসন। সেই চল্লিশের দশকে আমরা দেখেছি, তৎকালীন যাত্রাপালাগুলি ও অভিনেতারা কীভাবে গাঁয়ে-গঞ্জে-মহল্লায়-মহল্লায়, খেলার মাঠে, মেলার মাঠে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছিল ক্ষোভ। আর সে-জন্য যাত্রা লেখক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে কারাবাস, খুন, ধর্ষণ - কী অত্যাচারটাই না করেছে ব্রিটিশ সরকার! তবুও থেমে থাকেনি যাত্রাপালা, রক্তের কসম নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে গাঁ-গঞ্জের মাঠে মাঠে। তারপর স্বাধীন ভারতে দাঁড়িয়েও যাত্রাপালা কখনো চুপ করে থাকেনি, জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সংগ্রাম চালিয়েছে মানুষের খুব কাছে গিয়ে, মানুষকে বুঝিয়েছে অধিকার কেড়ে নিতে হয়, শিখিয়েছে হকের লড়াই।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের মাঠে মঞ্চস্থ হতে দেখা গেল এমনই এক যাত্রাপালা। ব্রহ্মরাজ চট্টপাধ্যায় রচিত ও পল্লব মুখার্জি সম্পাদিত সেই যাত্রাপালার নাম 'আগুন রাঙা ফাগুন বৌ'। অন্ধকারে বসে থাকা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অগণিত দর্শকের মাঝে আলো-আঁধারির মঞ্চে যে যাত্রাপালার প্রথম সংলাপ মঞ্চস্থ হচ্ছে তাতে দেখানো হচ্ছে এক মিলন মাঠের দৃশ্যকে, যে মাঠের একদিকে মসজিদে নামাজ পাঠ চলছে আর অন্যদিকে মন্দির যে দুর্গাপূজার মন্ত্রপাঠ হচ্ছে। এবং উৎসব শেষে সেই গ্রামের প্রত্যেক মানুষ ধর্ম-জাতির ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের উৎসবে সামিল হচ্ছে। যাত্রা শুরু হওয়ার পর গল্পটা ঠিক এইভাবেই চলল যেখানে মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে কিভাবে ভোটের লোভে, ক্ষমতার লোভে আজকের শাসকেরাও ধর্মের নামে মানুষকে লেলিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধে। সীমান্তে আজও গুলির শব্দ, পাড়ায়-পাড়ায় খিদের ধর্মকে ভুলিয়ে দিয়ে ভগবানের নামে শোনা যাচ্ছে দাঙ্গার আওয়াজ। আর তারই বিরুদ্ধে গাঁয়ের মাঠে, মেলার মাঠে এসে যাত্রাপালারা মানুষকে দেখিয়ে যাচ্ছে - আজানের শব্দে ঘুম ভাঙলে এ-ভারতবর্ষ শোনে মহালয়ার চণ্ডীপাঠ।

আর তাই আজও একমাত্র যাত্রার মঞ্চ বুঝিয়ে দিতে পারে - ধর্ম যার-যার, স্বদেশ সবার। যাত্রাপালা বুঝিয়ে দেয়, মানুষকেই সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, ভেঙে দিতে হবে ষড়যন্ত্র। ক্রমশ ছোট হয়ে আসা মাঠটাকে আরও বড় করতে হবে।

More From Author See More