বিশ্বযুদ্ধের ময়দান। আগ্নেয়াস্ত্র ঝলসে উঠছে প্রতি মুহূর্তেই। হচ্ছে বিস্ফোরণ। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধবিমান। পোকামাকড়ের মতো মরছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এক তরুণী। না, তাঁর হাতে বন্দুক নেই। নেই আত্মরক্ষার কোনো অস্ত্রও। বদলে, ধরা আছে ক্যামেরা।
কথা হচ্ছে সুনেকো সাসামোতোকে (Tsuneko Sasamoto) নিয়ে। তিনি জাপানের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক (Photojournalist)। সম্প্রতি ১০৭ বছর বয়সে বিদায় নিলেন জাপানের ফটোগ্রাফার সোসাইটির অন্যতম সদস্যা। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি। গত ১৫ আগস্ট তিনি নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গতকাল ‘জাপান প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফার সোসাইটি’-র তরফেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় এই দুঃসংবাদ।
১৯১৪ সালে টোকিও দক্ষিণে অবস্থিত কামাকুরা শহরে জন্ম সাসামোতোর। জাপানের ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্ট স্কুলে চিত্র অঙ্কন ও প্যাটার্ন ডিজাইনে অধ্যয়ন করেন তিনি। স্নাতকতা সম্পূর্ণ করার ঠিক পরেই নেমে পড়া সংবাদ-দুনিয়ায়। অবশ্য নিজের জায়গা পাকা করতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকবছর। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪০ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ জাপানে যোগদান করেন সাসামোতো। আর তারপরেই রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল তাঁর তোলা ছবি।
১৯৪০ সাল সেটা। জাপান, জার্মানি ও ইতালির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। সেই উপলক্ষে পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার মহিলা। সেই উদযাপনের ছবিই ক্যামেরাবন্দি করেন সাসামোতো। সেই সূত্র ধরে ক্রমশ জড়িয়ে পড়া বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে। শহরে থেকে কোনোদিন আরামের কাজ করতে চাননি তিনি। বরং, তাঁকে চিরকালই আকর্ষণ করেছে অভিযানের পথ, বিশ্বযুদ্ধের ময়দানের রোমাঞ্চ। বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন সাসামোতো। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের ক্যাবিনেট ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘শশিন শুহো’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবেই প্রকাশিত হত তাঁর তোলা ছবি। দেশপ্রেম এবং জাত্যাভিমান জাগিয়ে, জাপানের অনুপ্রাণিত করতেই এই লড়াই চালিয়েছেন সাসামোতো।
আরও পড়ুন
প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে মলোকাই চ্যানেল জয় কালনার তরুণীর
অবশ্য বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুদ্ধ-সম্পর্কে নিজের অভিমত থেকে অনেকটাই সরে আসেন তিনি। টোকিও-তে ফিরে কাজ শুরু করেন স্বাধীন সংবাদকর্মী হিসাবে। তৎকালীন জাপানি সংবাদ মাধ্যম ‘চিবা শিম্বুন’-এর চিত্রসাংবাদিকের ভূমিকায় হামেশাই দেখা যেত তাঁকে। তাছাড়াও জাপানে ফ্যাসিবাদ ও জাতীয়বাদের উত্থানের কারণ ও প্রতিবেশী দেশের ওপর বলপূর্বক দখল নিয়েও স্বাধীনভাবে একাধিক কাজ করেছেন সাসামোতো। তুলে ধরেছিলেন যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে শিল্পী, লেখক, কয়লা খনির শ্রমিক ও কৃষকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্টে সেইসব কাজ নথিভুক্ত রয়েছে আজও।
আরও পড়ুন
প্রাণীদের সঙ্গে কথপোকথন, পোষ্যের ভাষা শেখাচ্ছেন মার্কিন মহিলা
তবে বিশ্বযুদ্ধের পর খুব বেশিদিন সক্রিয়ভাবে সাংবাদিকতায় থাকেননি সাসামোতো। ৫০ বছর বয়সেই পেশাদার সাংবাদিকতায় ইতি টানেন তিনি। বেরিয়ে পড়েন ইউরোপ-ভ্রমণে। অবশ্য থেমে থাকেনি কলম। নিজের আত্মজীবনী-সহ, বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচারণ নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন সাসামোতো।
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা বাউন্সার, প্রথাগত ধারণা বদলাচ্ছেন উত্তরপ্রদেশের মেহরুন্নিসা
২০১১ সালে ইয়োশিকাওয়া ইজি কালচারাল পুরস্কার, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ জাপান পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন শতায়ু চিত্রসাংবাদিক। তাঁর তোলা ছবি জায়গা করে নিয়েছে গত ১০০ বছরের বিশিষ্ট ছবির প্রদর্শনীতেও। তবে শুধু সাংবাদিকতাই নয়, জাপানের শিক্ষা ও সমাজের বিকাশেও সাসামোতোর ভূমিকা অপরিসীম। জাপানি মহিলাদের কাছে তাঁর জীবনের এই লড়াই যেন হয়ে উঠেছিল দৃষ্টান্ত। বদল এনে দিয়েছিল সেখানকার সংবাদজগতে। এমন একজন ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে স্বাভাবিকভাবেই শোকস্তব্ধ সূর্যোদয়ের দেশ…
Powered by Froala Editor