পরনে কালো স্যুট, বুকে হলুদ ফুল। সামনে রাখা একটি সার্টিফিকেটের ফ্রেম। হাত মুঠো করে তিনি হাসছেন। মাত্র কয়েকদিন আগেই এমন দৃশ্যের সাক্ষী ছিল গোটা বিশ্ব। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই শোনা গেল দুঃসংবাদ। মারা গেলেন ওই ব্যক্তি, চিতেৎসু ওয়াতানাবে। তাঁর পরিচয় ওই সামনে রাখা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সার্টিফিকেটেই বলা ছিল। তিনিই ছিলেন বিশ্বের প্রবীণতম পুরুষ।
২০২০-এর ১২ ফেব্রুয়ারি গিনেসের তরফ থেকে সম্মান জানানো হয় ১১২ বছর বয়সী চিতেৎসু। অসুস্থ ছিলেন তখনই। বয়সের একটা প্রভাব তো পড়েই! তা সত্ত্বেও সক্রিয় ছিলেন প্রবলভাবে। কিন্তু বুকের সমস্যা আর জ্বর তাঁকে ছাড়ছিলই না। ঠিকমতো খেতেও পারছিলেন না। মৃত্যুতে তাঁর সেই সমস্ত কষ্টের উপশম হল।
১৯০৭ সাল। ঠিক দুই বছর আগে বঙ্গভঙ্গ হয়ে গেছে ভারতে। স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিস্থিতি উত্তাল। সেই সময়ই দূর জাপানের উত্তর অংশের নীলগাতায় জন্ম হয় তাঁর। পরিবারের বড় ছেলে চিতেৎসু ওখানকার অ্যাগ্রিকালচারাল স্কুল থেকে পাশ করে সোজা চলে যান তাইওয়ানে, সেখানকার আখ চাষের ক্ষেত্রে কাজ করেন। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে কদ্দিন থাকতে পারে মানুষ? ১৮ বছর পর ফিরে এলেন নিজের জায়গায়, জাপানে।
সেই সময় চিতেৎসু’র বিয়েও হয়ে গেছে। চার সন্তান। এরই মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন যুদ্ধে। ১৯৪৪-এর প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ফিরে আসার পরও, জীবনে আরেক যুদ্ধ। বিরাট সংসার, অথচ সামর্থ্য নেই সেরকম। প্রবল দারিদ্র্য দেখেছেন চিতেৎসু। গাছপালা, চাষ- ভালবাসেন এইসব। যুক্ত হলেন নীলগাতা’র সরকারি অ্যাগ্রিকালচারাল অফিসের সঙ্গে। সেখানেই আজীবন কাজ করে এসেছেন।
গাছপালার প্রতি ভালবাসা জারি ছিল শেষ পর্যন্ত। অবসর নেওয়ার পর বাড়িতেই তৈরি করতেন বনসাই। রীতিমত বড় বাগান তৈরি করে ফেলেছিলেন। ততদিনে নিজের বাড়িও হয়েছে। আস্তে আস্তে সময় এগিয়েছে। নিজের চোখে দেখেছেন নিজের নাতি-নাতনিদের; এমনকি তাঁরাও আজ বৃদ্ধ হয়েছেন। আর বহাল তবিয়তে সেঞ্চুরি করেও নট আউট থেকেছেন চিতেৎসু। কিন্তু এর রহস্য কী?
প্রশ্নটা যতবারই করা হয়েছে, বারবার হেসেছেন তিনি। হ্যাঁ, এই হাসিই তাঁর উত্তর। পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরাও বলতেন একই কথা। সবসময় হাসতেন। কখনই তাঁকে রাগতে দেখা যেত না; কোনোদিনও উঁচু গলায় কথা বলতেন না। অথচ সমস্ত ব্যাপারে নজর ছিল সমান। চিতেৎসু নিজেও বলতেন, ১০০ পেরিয়েও যে তিনি জীবিত তাঁর কারণ তিনি জীবনটাকে উপভোগ করেছেন। চরম দুঃসময়ও হাসি যায়নি তাঁর। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও তাঁর ছবিটি ছিল হাস্যময়। ১১২ বছরের এই তরুণ মানুষটি অবশেষে থামলেন। আনন্দ করে বাঁচাটাই যে জীবনে আসল, সেখানে দারিদ্র্য, টাকা, চাকরি- কিছুই আসবে না; সেটাই শিখিয়ে যান তিনি।