জাপানের জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে অনেকেরই প্রথম মনে পড়বে সুশি এবং সোবা নুডলের কথা। জাপানি রেস্তোরাঁয় রসনা-তৃপ্তি ঘটাতে গেলে নানারকম সুশি আর নুডলের ছবিই মনে পড়ে। অথচ, জাপানে কিন্তু ভাত-তরকারি বা রাইস কারিও সমান জনপ্রিয়! জাপানী নেভিতে নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার নেভি-ক্যান্টিনগুলিতে পালন করা হয় ‘কারি ফ্রাইডে’। সেদিন মেনুতে অবশ্যই থাকে জাপানী রাইস কারি। এই জনপ্রিয় রাইস কারি, আর তার জনপ্রিয়তম এক রেসিপি বা রন্ধন-প্রণালীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বঙ্গ-সন্তানের নাম! এমন এক বাঙালি, যাঁকে আমরা স্মরণ করি অন্য কারণে। তিনি আর কেউ নন -- বিপ্লবী রাসবিহারী বসু।
আনুমানিক ১৮৭০ সাল থেকেই জাপানের খাবার টেবিলে এই রাইস কারি জায়গা করে নেয়। ব্রিটিশ রয়াল নেভির আধিকারিকরা এই ভারতীয় পদ্ধতিতে সবজি খাওয়ার অভ্যেস নিয়ে গেছিলেন জাপানে। শিখিয়েছিলেন জাপানি সহকর্মীদের। মিসেস বিটন নামক এক ইংরেজ মহিলার রান্নার বই থেকে পাওয়া যায় প্রাচীন সেই রাইস কারি-র প্রণালী; যা অনেকটাই ইংরেজদের পছন্দে প্রভাবিত। টক সবুজ আপেল আর ময়দা ব্যবহার করে। যেহেতু ব্রিটিশদের থেকে শেখা, জাপানীদের কাছে তা হয়ে গেল পাশ্চাত্যের ডেলিকেসি।
কিন্তু টোকিও শহরে এখনও এমন এক রেস্তোরাঁ আছে, যারা গর্বের সঙ্গে ভিন্ন ধারার ট্র্যাডিশনাল রাইসু কারি প্রস্তুত এবং পরিবেশন করে আসছে। তাদের এই ‘অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কারি’-তে কোনো ময়দা বা আপেল নেই। বেশ ঝালঝাল, মশলাদার। এই ইন্ডিয়ান কারি তাদের কাছে ইতিহাসের গৌরবময় এক অধ্যায়। সেই ঐতিহ্যময় রেসিপি আজও ধারণ করে আছে জাপানী রেস্তোরাঁ প্রস্তিষ্ঠান নাকামুরায়া (Nakamuraya)।
১৯১২ সালে বড়োলাট চার্লস হার্ডিং-কে হত্যার চেষ্টা, এবং তারপর লাহোর ষড়যন্ত্র... রাসবিহারী বসু হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজ সরকারের কাছে 'মোস্ট ওয়ান্টেড'। মাথার দাম ঘোষণা হয়ে গেছিল। সহযোদ্ধা বিপ্লবী শ্রীষ চন্দ্র ঘোষ সহ অনেকের পরামর্শে অবশেষে উনি কলকাতা বন্দর থেকে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ১৯১৫ সালে। নকল পরিচয়পত্র - প্রিয়নাথ ঠাকুর; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন।
টোকিওতে পৌঁছনোর পর তাঁর আলাপ হয় কিছু জাপানের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে, যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সংবেদনশীল। তাঁদের মধ্যেই একজন ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা মিৎসুরু তোয়ামা। তোয়ামা'র উদ্যোগেই রাসবিহারী বসুর সঙ্গে পরিচয় হয় সোমা পরিবারের। একটি প্রতিষ্ঠিত বেকারীর মালিক আইজো সোমা, বেকারির নাম নাকামুরায়া (এই বেকারিই ক্রমে ব্যবসায় প্রসার ঘটিয়ে রেস্তোরাঁ হয়ে ওঠে)। জাপানের ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে চাপ বাড়ছিল, রাসবিহারীকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। মাসের পর মাস রাসবিহারী লুকিয়ে রইলেন নাকামুরায়া বেকারিতে, সোমা পরিবারের ছত্রছায়ায়। জাপানি ভাষা বলতে বা বুঝতে সমস্যা হত, সোমা পরিবারের বড় মেয়ে তোশিকো সোমা হলেন রাসবিহারীর দোভাষী। রাসবিহারীকে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এবং কূটনৈতিক চাপ থেকে রক্ষা করার পেছনে এই সোমা পরিবারের অবদান অনেক। তোশিকো নিজে বর্মর মতো রক্ষা করেছেন আমাদের প্রণম্য বিপ্লবীকে।
এর মাঝেই ইংরেজদের জাহাজ জাপানি বাণিজ্য জাহাজের ওপর গোলাবর্ষণ করল, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় জাপান সরকারও বাতিল করল রাসবিহারী বসুকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সব রকম জল্পনা।
আরও পড়ুন
দ্বিজেন্দ্রগীতি গাইছেন জাপানি তরুণ-তরুণী, বাংলায় গান বেঁধেছেন নিজেরাও
ব্রিটিশ-জাপানি কূটনীতি আর গোয়েন্দা-বিভাগের টানাপোড়েনের মাঝেই বছর কাটতে লাগল। ১৯১৮ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন তোশিকো এবং রাসবিহারী (বোঝা যায়, এও রাসবিহারীর নিরাপত্তার কথা ভেবে)। পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবন, নিজেদের বাড়ি হল। তবে সে সুখ দীর্ঘমেয়াদি হল না। ১৯২৩-এর ভয়ানক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল জাপান, তাঁদের বাসাও ক্ষতিগ্রস্ত হল। এরপর শারীরিক ও মানসিক চাপ, দু বছর পরই যক্ষা আক্রান্ত হয়ে অবশেষে মৃত্যু হল তোশিকোর, ১৯২৫-এ। এক পুত্র আর এক কন্যার হাত রাসবিহারীর হাতে রেখে আবার তাঁকে একা করে দিয়ে চলে গেলেন।
শোকাহত রাসবিহারী নিজের মনকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য শ্বশুরমশাই আইজো সোমার সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসায় সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন একটি ছোটো রেস্তোরাঁ যেখানে ভারতীয় (আসলে বাঙালি) কায়দায় কারি-রাইস বিক্রি করা হবে। জাপানিরা পাবে ভিন্ন এবং নতুন স্বাদের কারি রাইস।
জাপানে থেকেও রাসবিহারী বসু দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন, সেই মহান কর্মকাণ্ডের ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু এসব কিছুর মাঝে তাঁর এক ভিন্নধর্মী অবদান হল ১৯২৭ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নাকামুরায়া ক্যাফে এবং সেখানে ‘অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কারি’ নামে এক বিশেষ পদের প্রচলন। এর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে একটুকরো 'বাঙালিয়ানা'-র ইতিহাস। নতুন রেস্তোরাঁ এবং এই অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কারির জনপ্রিয়তা রাসবিহারী বসুকে আরও জনপ্রিয় করে তুলল জাপানিদের মাঝে। সংবাদপত্রে ওঁর বিপ্লবী জীবন এবং তোশিকোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে লেখা শুরু হল। ‘বোস অব নাকামুরায়া’ হয়ে উঠলেন সকলের মাঝে এক সমাদৃত নাম। ইন্দো-কারি হয়ে উঠল জাপানি নাগরিকদের মাঝে বিপ্লব আর প্রেমের প্রতীক। ‘বোস অব নাকামুরায়া’-তে প্রফেসর তাকেশি নাকাজিমা জানাচ্ছেন -- বোস সচেতন ভাবে চেয়েছিলেন, জাপানিরা জানুক তারা যে কারি খাচ্ছে তা আসলে উপনিবেশের মানুষদের খাবার। তিনি তাঁর নিজস্ব রন্ধন-প্রণালী নাকামুরায়ার মেনুতে আনলেন, তা ছিল এক সচেতন প্রয়াস... “part of his anti-colonial struggle, by trying to win back India’s food culture from British hands.” সেই ইন্ডিয়ান কারি জনপ্রিয় হয়ে উঠল দ্রুত। প্রচলিত রাইসু কারি-র থেকে আটগুণ বেশি দামে বিক্রি হলেও তার ডিম্যান্ড কমল না! আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না, রাসবিহারী বসুর এই রন্ধনপ্রণালী ছিল নিখাদ বাঙালি রান্নার প্রণালী। ঝালঝাল মাংসের ঝোল-ভাত।
আরও পড়ুন
স্পষ্ট ও নির্ভুল বাংলা তাঁর, ভালোবাসেন রসগোল্লা-ইলিশ - জাপানি তরুণীর ভিডিও ভাইরাল
১৯৪৪ সালে পুত্র মাসাহিদে বোস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হয়ে যান, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। অসুস্থ হয়ে পড়েন রাসবিহারী। ফুসফুসে সংক্রমণ এবং রক্তক্ষরণ। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর, অবশেষে ২১শে জানুয়ারি ১৯৪৫-এ আমাদের শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী জাপানের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে। ইম্পেরিয়াল জাপানি সরকার তাঁকে ভূষিত করল বিদেশিদের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মানে -- The Second Order of Merit of the Rising Sun। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হল ইম্পেরিয়াল শকটে রাজকীয় সম্মান দিয়ে। সমাধিস্থ করা হল স্ত্রী তোশিকোর সমাধির পাশে।
তারপর ৭৫ বছর অতিক্রান্ত, তাঁর সেই স্পেশ্যাল রেসিপি আজও বুকে আঁকড়ে রেখেছে নাকামুরায়া... বিপ্লব ও প্রেমের স্বাদ ‘অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কারি’। এখনও তা জনপ্রিয়তম খাদ্যগুলির একটি। জানা যায় -
২০০১ সাল থেকে প্যাকেজ কারিও ডেলিভারি করছে এই প্রতিষ্ঠান, দোকানে দোকানে পাওয়া যাচ্ছে 'অরিজিনাল বোস রেসিপি কারি'। এর থেকেই নাকি নাকামুরায়া প্রসেসড ফুডস ডিভিশন অর্ধেক এর বেশি লাভ করছে। সেই লাভের অঙ্ক বাৎসরিক এক বিলিয়ন জাপানি ইয়েনের থেকেও বেশি! যেন জাপান এবং সোমা পরিবারের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ রাসবিহারী বসুর 'অসংখ্য ধন্যবাদ' জানানোর অভিনব কায়দা, যা আজও 'রিটার্ন' দিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ঝাড়ুদার থেকে ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়’ – রাসবিহারীতে নাস্তানাবুদ পুলিশ
Powered by Froala Editor