জনশূন্যতা দূর করতেই পুতুল বানান জাপানি বৃদ্ধা

নিম্ন জন্মহারে কমছে জাপানের (Japan) জনসংখ্যা। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটির রিসার্চ এমনই। বলা হচ্ছে, ২০৪৯ সালের মধ্যে দেশটির জনসংখ্যা ১০ কোটি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা। এমন পরিস্থিতিতে তোকুশিমা এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম নাগোরোর (Nagoro) বাসিন্দা আয়ানো সুকিমি  (Ayano Tsukimi) অদ্ভুত কার্যকলাপ নিয়ে এগিয়ে আসেন।

জাপানের শিকোকু দ্বীপে একসময়ের প্রাণবন্ত আবাসিক এলাকা দেখে দুঃখ পান তিনি। বছরের পর বছর ধরে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে সেখানে। কমতে কমতে গ্রামটির লোকসংখ্যা মাত্র ৩০। স্বাভাবিক ভাবেই নাগোরো তার আকর্ষণ হারাতে থাকে। গ্রামটিকে জনবহুল করার জন্য লাইফ-সাইজ পুতুল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুকিমি।

গত কয়েক বছর ধরে মিডিয়াকে দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সুকিমি জানিয়েছেন, তাঁর মা মারা যাওয়ার পর অসুস্থ বাবার দেখাশোনা করতে তিনি ওসাকা থেকে জন্মভিটে নাগোরোতে ফিরে আসেন। ওই সময়েই (২০০২ সালের দিকে) তিনি একটি কাকতাড়ুয়া তৈরি করেন। বাগানে বীজ চুরি করা পাখিদের তাড়ানোর জন্যই এই পন্থা। কাকতাড়ুয়াকে পরিয়ে দেওয়া হয় সুকিমির বাবার পুরনো পোশাক। পাখি তো বটেই, সেই কাকতাড়ুয়াকে দেখে বোকা বনে 'হ্যালো' বলেছিল এক কর্মীও। কিন্তু কে জানত, ধীরে ধীরে তাঁর এই স্ক্যারক্রোই গ্রামটিকে 'পুতুলের গ্রামে' পরিণত করবে!

সুকিমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তাঁর গ্রামের জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, বয়স্করা মারা যাচ্ছেন, স্কুল এবং দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তরুণরা আরও ভালো সুযোগের জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। যে গ্রামে তিনি খেলে বেড়িয়েছেন, মজা করেছেন আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, সেসব বাড়ি আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যেতে দেখে মনখারাপ হয়ে যেত। সপ্ততিপর বৃদ্ধা সুকিমি ঠিক করলেন আরো পুতুল বানাবেন। এতে একাকিত্ব দূর হবে। গ্রামের জীবনকেও প্রতিনিধিত্ব করবে তারা।  জনশূন্যতা দূর করতেই তাঁর এই উদ্যোগ। অনেকেই নাকি নিঃসঙ্গতা অনুভব করলে কথা বলেন পুতুলগুলির সঙ্গে।

আরও পড়ুন
গাছের ডালে হাজার হাজার ঝুলন্ত পুতুল, ‘পুতুল দ্বীপ’-এর কাছে হার মানে সিনেমাও!

যদিও মৃত বাসিন্দাদের স্মরণে এই পুতুলগুলি তৈরি করার জন্য স্ক্যারক্রো তৈরির দক্ষতাকে পরিমার্জন করেছিলেন সুকিমি। তিনি কিছু কাল্পনিক চরিত্রও যুক্ত করেন। আয়ানো প্রায়শই কথা বলতেন তাঁর একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। সেই প্রতিবেশী মারা গেলে তাঁর স্মরণে পুতুল তৈরি করে কাল্পনিক কথোপকথনও চালিয়ে যেতেন তিনি। মা ও ঠাকুমার আদলেও পুতুল গড়েছেন। পুতুল তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে তাঁকে দু-ঘণ্টা দূরের শহরে যেতে হয়।

আরও পড়ুন
বিক্রি তলানিতে, তবু পুতুল শিল্পকে আঁকড়েই দিনবদলের অপেক্ষায় নতুনগ্রাম

গ্রামটিতে অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল। সেখানে বাবা-মা, শিক্ষক এবং অন্যান্য চরিত্ররাও পুতুল হয়ে শোভা পায় এখন। প্রতিটি লাইফ সাইজ পুতুল তৈরি করতে কত সময় লাগে? প্রায় তিন দিন। খবরের কাগজ, তুলো, বোতাম, ইলাস্টিক ফ্যাব্রিক, তার, রং ব্যবহৃত হয় পুতুল তৈরিতে। পরে পুরনো কাপড়ের জামা পরিয়ে দেওয়া। তবে কেবল পুতুল তৈরিই নয়, তাদের রক্ষণাবেক্ষণও করেন সুকিমি। বিশেষ প্রয়োজনে পুতুল বদলেও যায়. সেক্ষেত্রে ফের নতুন করে বানাতে হয় ‘কাকাশি’। প্রতিটি পুতুলকে আবার নামও দেওয়া হয়েছে। আয়ানো তাদের নামের রেকর্ড নথিভুক্ত করে রাখেন।

স্থানীয় ভাষায় পুতুলগুলিকে বলা হয় ‘কাকাশি’ (Kakashi)। পুতুল তৈরি শিখতে অনেকেই আয়ানোর কর্মশালায় যোগ দেন। গত কয়েক বছর ধরে নাগরোয় আয়োজিত হচ্ছে বার্ষিক পুতুল উৎসব। এই মূল হোতা তিনিই। সাধারণত অক্টোবরের প্রথম রবিবার অনুষ্ঠিত হয় পুতুল উৎসব।

এভাবেই আয়ানো এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে তৈরি করেছেন ৩৫০টি পুতুল। পুতুলের সংখ্যা গ্রামটির বর্তমান মূল জনসংখ্যার ১০ গুণের চেয়েও বেশি। পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতেও সুকিমির তৈরি পুতুল দৃশ্যমান। গ্রাম ঘুরতে আসেন যাঁরা, তাঁরা দেখেন সাবেক এক মুদি দোকানের সামনে কারোর সমাগম, কেউ কেউ আবার বাস স্টপে অপেক্ষা করছেন, কারোর বিয়ে হচ্ছে, কোনো দম্পতি বসে আছেন বেঞ্চে, শিশুরা দোলনায় খেলছে, কেউ বই পড়ছে— এসবই পুতুল, প্রাণহীন ক্রীড়নক মাত্র। তবে মনে করলেই কথা বলা যায় তাদের সঙ্গে, প্রাণ খুলে তাই খোশগল্প করেন পর্যটকরাও।

চিত্রঋণ : RoYumi-Vive japon

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More