আমার শ্বশুরবাড়িতে তিন ধরনের জুতো ব্যবহার করা হয়। তিন ধরনের। ঘরে পরার, ছাদে পরার, আর ঘর থেকে বাইরের জুতো পরতে যাওয়ার মাঝে, তিন পা রাস্তাটুকুতে পরার। একবার আমি ঘরে পরার চটি পরে ছাদে চলে গেছিলাম। সারারাত আমার বউ আমায় ঘরে ঢুকতে দেয়নি। আমার শ্বশুরবাড়িতে, আমি আর আমার ভায়রা ভাই, দুই জামাই বাদে সবাই গান গায়। মানে, সকালে শ্বশুরমশাই আপন খেয়ালে স্বরচিত রাগ ভাঁজেন, তারপর বাজার যান। সেই সময়টুকু শাশুড়ি মা ভয়াবহ ক্ষিপ্রতায় রান্নার জোগাড় করতে করতে টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে ‘সকালবেলার সুর’, ‘ভোর হল, দোর খোল’ জাতীয় অনুষ্ঠানে গান শোনেন। আর ঘুম থেকে উঠে আমার শ্যালিকা নানান বিচিত্র খেয়াল গাইতে থাকেন।
আমার স্ত্রী ভাগ্যিস একটু দেরিতে ওঠেন; উঠেই অতুলপ্রসাদী গজল গাইতে থাকেন। কী বললেন? অতুলপ্রসাদ গজল লেখেননি? নজরুল তো লিখেছেন! উনি দু’টোকে মিলিয়ে গান। সেসব প্রকাশ্যে গাইবার জিনিস নয়, একান্ত সাধনার ব্যাপার। আমার শ্যালিকার একটি মহা বেয়াড়া ছেলে আছে। সে ক্লাসিকাল গান শেখে, আর বিচিত্র সব জানোয়ারের ডাক নকল করে তাদের সুরেলা ভার্শন আমায় শোনায়।
শ্বশুরবাড়ি গেলে এভাবেই আমার ঘুম ভাঙে।
শাশুড়ি মা রোজ সকালেই বেখাপ্পা রকম ব্যস্ত থাকেন। কেন, বলা মুশকিল। উনি অকারণে চঞ্চল। ধরা যাক, পাম্প চালানো হয়েছে। জল ভর্তি হবার পর সবে জল পড়তে শুরু করেছে। উনি বাড়ির যে প্রান্তেই থাকুন, দৌড়ে আসবেন। সুইচ অফ করতে। এবং এই দৌড়নোর সময় ক্যাম্বিস বলের মতো অবধারিত তিনটি দেয়ালে ধাক্কা খাবেন। ধরুন, সকালের খাবার বানানো হয়েছে। জামাইরা গেলে সে মারমার কাটকাট সব আয়োজন হয়। লুচি, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, তিন রকম সন্দেশ, মিহিদানা, ল্যাংচা— এসব তো নর্মাল। আমার বউ ইলিশ মাছও কাঁটা চামচ দিয়ে খান। তাই ওঁর জন্য লুচি অন্যরকম হয়। আমার দেড়েল বাচ্চাটা এসব খায় না। ও রোজ সকালে একই জিনিস খায়। রুটি, ম্যাঙ্গো জ্যাম, পেয়ারা জ্যাম, কালো জাম!
আরও পড়ুন
২০০ বছর আগে জামাই ঠকাতে তৈরি, হুগলির জলভরা সন্দেশের স্বাদে মজেছে সারা বাংলাই
রুটি
ম্যাঙ্গো জ্যাম
পেয়ারা জ্যাম
কালো জাম!
আরও পড়ুন
শ্বশুরমশাইয়ের চোয়াল নাকি ‘ঘোড়ার মতো দীর্ঘ’, হিসেব কষে ষষ্ঠীতে যেত জামাই
আর এই খাওয়ার সময় সকাল ন’টা সতেরো। তার তিন মিনিট দেরি হওয়াকেও আমার শাশুড়ি মা সামূহিক পরাজয় বা পারিবারিক বিপর্যয় মনে করেন। আর সকালের এই গোটা সময়টা আমি ‘ঘরে পরা চটি’ পরে ঘুরি। কারণ ঘর মোছা হয়নি তখনও। এই চটি পরে আবার বাথরুমের সামনে রাখা পাপোসের উপর দাঁড়ানো যায় না। সেখানে খালি পা রাখতে হয়। এসবের অন্যথা হলে শাশুড়ি মা আমার শ্বশুর মশাইকে বকেন। আর আমার বউ আমায় অপদার্থ বলে ভর্ৎসনা করেন।
আরও পড়ুন
বাংলার জামাই তিনি, ভোজনরসিক ও নেশায় ব্যোম - ‘ভুঁড়িওয়ালা’ শিবকে এভাবেই আপন করেছি আমরা
আমি একটা চটি পরতে ভুলে গেছি বলে, আমায় অপদার্থ, অকর্মণ্য, অসুস্থ, অস্বাভাবিক আরো কত কীই না বলেন আমার বউ!
এই সব থেকে ছুটি পাবার একটা দিন, জামাইষষ্ঠী। ওই দিন যখন শ্বশুরবাড়ি যাই, শাশুড়ি মা মেয়েদের বলে দেন, দুই জামাইকে বকাঝকা একটু কম করতে।
আমার ভায়রা ভাই স্বল্পাহারী। কিন্তু আমুদে, খাদ্যরসিক। তিনটের জায়গায় আর একটা লুচি চাইলে শাশুড়ি মা আপ্লুত হয়ে যান, কিন্তু আমার কড়া প্রফেসর-শ্যালিকা বরের দিকে বিলোল কটাক্ষ হানেন। ভায়রা ভাই, ‘আচ্ছা থাক্’ বললেও মায়ের প্রশ্রয়ে আরেকটি লুচি খান। আমি এমনিতেই রাক্ষসের মতো গিলি। ডজনখানেক লুচি আর হাফ ডজন সন্দেশ আমার রোজের খোরাকেই বরাদ্দ। জামাইষষ্ঠীতে এর বেশি খেলে তখন আমার স্ত্রী আপত্তি করেন। গত ষষ্ঠীতে আমাদের সব খাবারে স্যানিটাইজার ঢালা হয়েছিল বোধহয়। মনে আছে, গেল বার পোলাও, তিন-চারটে ডাঁটিওয়ালা বেগুন ভাজা, দু’বাটি সোনা মুগের ডাল আর খান তিনেক পাবদা, দু’টো কাতলার পেটি, হাফ কেজি পাঁটার মাংস, সঙ্গে সের খানেক রাবড়ি দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। গানপাগল শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য একটা বই নিয়ে গেছি। শ্বশুর মশাইকে বললাম, স্যার, বইটা দেখুন। ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’। উনি বললেন, কী নাম? কুদরত নন্দীভৃঙ্গী? আমি আর কথা বাড়াইনি।
আমি আমার শ্বশুরকে ‘স্যার’ বলি। তো?
আমার এক কলিগ, ওঁর শাশুড়ি মা-কে ‘দিদি’ বলেন। বলেন তো বলেন, তাতে আমার-আপনার কী? তা আমার সেই শ্বশুরমশাই-স্যার, আপনভোলা মানুষ। গালিগালাজ নিয়ে কীসব গবেষণা করেছেন, অথচ নিজে কখনও নিরামিষ গালিগালাজও দেন না। শুনেছি, শঙ্খবাবুকে একবার জয়দেব বসু ঘরদোর আটকে ধরেছিলেন, ‘স্যার, একবারটি ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা’ বলুন! আমি শুনব।’ আমিও সেই পথ নেব, ভাবি মাঝেমাঝে। অবশ্য, এ গল্পের একটু ডিফারেন্ট ভার্শনও আছে। জয়দেবের লাগাতার খোঁচানিতে অতিষ্ঠ মিতবাক শঙ্খবাবু, শোনা যায়, কেবল ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা’তেই থামেননি। আরো সব মণিমুক্তো ওই কম্বুকণ্ঠে বিতরণ করেছিলেন! শোনা কথা, ডিসক্লেমার দিয়েই রাখলাম। যাই হোক, এই পরের ভার্শন শুনে সে শখ বিসর্জন দিয়েছি। তা আমাদের আপনভোলা শ্বশুরমশাই-স্যার একবার জামাইষষ্ঠীর বাজার করতে গিয়ে, ঈশ্বর জানেন কেন, একডজন কাঁচকলা নিয়ে এলেন। শাশুড়ি মা আনতে বলেননি, তাও আনলেন। বোধহয় কাঁচকলার কোপ্তা খাওয়াবেন বলে। কিংবা, এমনিই, জামাইষষ্ঠীকে আর পাঁচদিনের মতো নর্মালাইজ করতে। বাড়িতে রীতিমতো একপ্রস্থ বোমা বিস্ফোরণের পর ওই খুদে বজ্জাতটা ঠিক করল, কাঁচকলার গাছ লাগাবে। আর আমার শ্যালিকা রেডিও ফিজিক্সের সঙ্গে সঙ্গে শখের কেক-বিশেষজ্ঞাও। তিনি কাঁচকলার কেক বানিয়েছিলেন।
এমনই এক জামাইষষ্ঠীর দিন, ঠিক হলো, দূরসম্পর্কের কোন এক শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হবে। মামা বা কাকা— কোনো একপ্রকার শ্বশুর হবেন তাঁরা। আমি এমনিতেও সম্পর্ক মনে রাখতে পারি না। ফলে, ঘরে পরার চটি পরতে ভুলে গেলে যেমন, তেমনি সম্পর্ক গুলিয়ে ভুলে গেলে আমার বউ আমায়, জামাইষষ্ঠীর দিন বাদে, অপদার্থ ঠাওড়ান। সেই মামাশ্বশুরের বাড়ি এক সুতীব্র কুকুর আছে। তখন তেনার বছর খানেক বোধহয়। লম্বায় সেই ঊনত্রিশের আমার সমান! যেতেই লাফ মেরে আমার ঘাড়ে উঠে চাটতে শুরু করল! এবার আমি তো আর কুকুরকে পাল্টা চেটে তাক লাগিয়ে দিতে পারি না। চুপ করে স্থির হয়ে নিশ্চল পাথরপ্রতিমার মতো স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাকি সবাই কুকুরপ্রেমী। তাঁরা আমোদ পেলেন। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। আমার ছেলে খুদে শয়তানটা আমার অবস্থা থাকা দেখে মিচকি মিচকি হাসছিল। একবার ভাবলাম, দিই ওর গায়ে টিকটিকি ছেড়ে। তারপর মনে পড়ল, আমার তো টিকটিকিতেও ভয়! আর আমার সেই মামা, না কাকা - কী একটা শ্বশুর কিনা জামাইষষ্ঠীর দিন, আমায় বলছিলেন, ‘তুমি ভয় পেয়ো না। ও মাত্র ছিয়ানব্বই পারসেন্ট নেকড়ে!’
মানে? একটা ছিয়ানব্বই শতাংশ নেকড়েকে ভয় না পেলে কাকে ভয় পাব? এমন বেআক্কেলে জামাইষষ্ঠীর ফলে আমি বড্ড মনমরা হয়েছিলাম। তাই পরেরবার আমার আরেক মামাশ্বশুর, ইনি দূর সম্পর্কের নন, আমাদের ডাকলেন। গেলাম। দলবেঁধে। গিয়ে দেখি জমকালো আয়োজন। এক বেয়ারা সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাস সাজাচ্ছেন। আমার শ্বশুরমশাই ভাবলেন, জল দেবে বোধহয়। তা জল দিতে অতো ঘটা করার দরকার কী? বোতলে দিলেই তো হয়।
আমার শ্বশুরবাড়ির এই এক আশ্চর্য। সেখানে সব কিছু অতো নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন, তিনরকম চটিওয়ালা, শুধু জল কেউ গ্লাসে নিয়ে খান না। বোতল থেকে সরাসরি। আমি ওসব পারিনে। আমি খাগড়াই কাঁসার দেশের লোক। একটা গ্লাস মাজা থাকে আমার জন্য। সেই যে একবার, বোতল থেকে সরাসরি গলায় ধেনো ঢালতে গিয়ে বুকে আটকে মরেই যাচ্ছিলাম, তারপর থেকে আর রিস্ক নিই না। গেলাসে ঢেলে খাই। কিন্তু বেয়ারাকে অতো গ্লাস সাজাতে দেখে শাশুড়ি মা গেলেন প্যারানয়েড হয়ে। অতো গ্লাস ওদের আবার মাজতে হবে? আহা গো! না না বাছা, অত গ্লাস এঁটো কর না, আমরা বোতল থেকেই খেয়ে নেব। কী গো?
‘কী গো’। একটি প্রজন্মান্তরে বহমান সম্বোধন আমার শ্বশুরবাড়ির। আমার শাশুড়ি মা শ্বশুর মশাইকে ডাকেন। আমার শ্যালিকা, ভায়রাকে ডাকেন। আমার স্ত্রী আমায়। শ্যালিকার ছেলে তো বহুদিন জানতো, ওর বাবা আর মেসোর ডাকনাম একই— কীগো!
তা সেই ‘কী গো’ শুনে, শ্বশুরমশাই সায় দিলেন, ‘ঠিকই তো। অত গ্লাস-ফাস লাগবে না। বোতল থেকেই ঢকঢক করে মেরে দেব!’
ওঁরা সরল মানুষ। জল অর্থে বলেছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে যারপরনাই অপ্রস্তুত হন। কিন্তু আমি পোড়খাওয়া সর্বনেশে। দেখেই বুঝেছিলাম, গ্লাস কী জন্য সাজানো হচ্ছে। মামাশ্বশুর, জামাইষষ্ঠীতে নতুন জামাইদের দু’এক পেগ দামি মদ খাওয়াবেন ব’লে। নিমেষে ভদ্রলোকের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেছিল।
আর সেই বেয়ারা? তিনি কী বুঝেছিলেন জানি না, শুধু এক প্রগাঢ় বিস্ময় আর শ্রদ্ধার ককটেল চোখে নিয়ে বাকি সময়টা ‘বোতল থেকেই ঢকঢক করে মেরে দেব’দের দেখেছিলেন।
খুব ছোটোবেলা থেকে আমার মাত্র দুটোই শখ ছিল। আমার বুকে অনিল কাপুরের মতো লোম থাকবে। আর জামাইষষ্ঠীর দিন গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে আমি শ্বশুরবাড়ি যাব। পাঞ্জাবির বুকের দু’টো বোতাম খোলা। সুনীল গাঙ্গুলির কবিতার মতো। ছোটোবেলা থেকেই দেখতাম, নতুন জামাইগুলোর এই দিন চেকনাই বেড়ে যেত। এমনিতে বাড়িতে লুঙ্গি কিংবা বারমুডা পরে ঘোরে। অমানুষিক একটা ভুঁড়ি নিয়েও খালি গায়ে পৈতে চুলকোয়। জামাইষষ্ঠীর দিন বগল ফুলিয়ে আসতো। যেন নতুন কোনো কারখানা কিনেছে ! আমার এক লতায়-পাতায় মামা রোজ তিন প্যাকেট ক’রে পতাকা বিড়ি খেতেন। আর কালান্তক কাশতেন। সে কী কাশি রে ভাই! আর কাশির শেষে অবধারিত ‘ঘ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যাক্’ করে এক চামচ কফ তুলে ফেলতেন। আবার বিড়ি খেতেন। জামাইষষ্ঠীর দিন কিন্তু ভদ্রলোক ওইরকম মাঞ্জা মেরে সিগারেট খেতেন।
সেই থেকেই বুঝেছিলাম দিনটার মাহাত্ম্য। বেসিক্যালি আমি বিয়ে করতে চাইতামই জামাইষষ্ঠীর লোভে। আমার বাবা অল্প কথার মানুষ ছিলেন। ছিলেন। না না, দুঃখ পাবেন না। এখনও বহাল তবিয়তে আছেন, কিন্তু গত দশ বছর প্রবল বকেন। সেই যেবার লোকসভা ভোটে হেরে সিপিএম ল্যাজে-গোবরে হল, তখন থেকে। আগে এমনটা ছিলেন না। জামাইষষ্ঠীর দিন ভদ্রভাবে মৃদুভাষী আমার বাবা শ্বশুরবাড়ি যেতেন। আর বাবা ঘরে ঢুকলেই আমার অশীতিপর দিদা সাদা কাপড়টা মাথায় ঢাকা দিতেন। জামাই ব’লে কথা। আমার মায়ের এক পিসি, অতি স্নিগ্ধ মানুষ ছিলেন। বাবা মাঝে মাঝে জামাইষষ্ঠীতে তাঁর কাছেও যেতেন। সেই বুড়িকেও দেখতাম, নয়ের কোঠায় বয়েস, তখনও রামায়ণ-মহাভারত পড়েন, বাবা ঢুকতেই একগাল ফোকলা হেসে ঘোমটা টানার জন্য আঁচল হাতড়াতেন। পিসিঅন্তপ্রাণ আমার মা ঘোমটা দিতে সাহায্যও করতোসেই দিদাকে। বাবার জামাইষষ্ঠী আর সেভাবে হয় না। আমি বড়ো হয়েছি। অনিল কাপুর হতে পারিনি। কিন্তু জামাই আদরে তা বলে ঘাটতি নেই।
তা এমনই এক জামাইষষ্ঠীর দিন, আমার বিয়ের পাকা কথা বলতে হবু শ্বশুরবাড়িতে হাজির হয়েছিলেন আমার মা-বাবা, মাসি, মামারা। শাশুড়ি মা যথারীতি টেনসড। আর স্বর্ণযুগের কুমার শানুর মতো ব্যস্ত। ভায়রা ভাই জামাইষষ্ঠীর আশীর্বাদ ইত্যদির মাঝেই আমার সঙ্গে রঙ্গ করছেন। শ্যালিকাও খোশমেজাজে। ওই ফিচেল ছোকরা তখন ছোটো, এতোটা বদ হয়নি, কিন্তু মাঝেমাঝেই আমার গোঁফ টেনে আমায় জ্বালাচ্ছে। আর আমি সব সহ্য করছি আগামী বছরের কথা ভেবে। আমার বউ, তখনও বান্ধবী ছিলেন, কিন্তু মেজাজে গিন্নিপনা ছিল ষোল আনা। আমায় আগেই সতর্ক করেছিলেন, বিয়ে নিয়ে একদম আদিখ্যেতা করবে না। সংযত থাকবে।
তাই ছিলাম, জানেন। বসে বসে ভেড়া গুনছিলাম মনে মনে। কিন্তু বেলা বয়ে যায়, কেউ আর ছাই পাকা কথা বলেই না! আমার মাসি, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। প্রবল পড়ুয়া। হঠাৎ শ্বশুরমশাই-স্যারকে শুধোলেন, আচ্ছা দাদা, মানুষের মূল্যবোধ কি ক্রমশ কমে যাচ্ছে?
ব্যাস! একে মা মনসা, তায় সাকালাকাবুমবুম! আমার অধ্যাপক শ্বশুরমশাই সব ভুলে মেতে উঠলেন মূল্যবোধের মূল্যায়নে। কী ভীষণ গভীর আর বোরিং এক আলোচনা। আমি কোথায় ভাবছি, বিয়ের মেনু ঠিক হবে, ভেন্যু ঠিক হবে, হানিমুনে কোথায় গেনু ঠিক হবে! তা না, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বিপিন পাল- নানান রেফারেন্সে বাঙালির মূল্যবোধের বিচার চলছে। ওদিকে শাশুড়ি মা বড়োজামাই-বরণ চালাচ্ছেন, আর আমি চাতকের মতো অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে, ডুকরে বলি, এরপরের আলোচনা আমিই ইনিশিয়েট করব, বিশ্বাস করুন। লিটল ম্যাগাজিন কেন বর্জন করা উচিত, বাংলা ব্যান্ডের গানে কেন নর্দমার বাড়বাড়ন্ত, শনিবারের বারবেলায় মোচার ঘন্ট খাওয়া যায় কিনা, কিংবা ‘চাঁদ কেন আসে না আমার ঘরে’, যা বলবেন তাই নিয়ে সন্দর্ভ, প্রতর্ক, ডিসকোর্স সব নামিয়ে দেব, কিন্তু তার আগে আমার বিয়েটা? জোড়হাত করছি ধর্মাবতার, আমার বিয়ের পাকা কথাটা! মাইরি বলছি, ‘বাংলা সাহিত্যে তুতেনখামেন’ অবধি থিসিস নামিয়ে ফেলব, কিন্তু আপাতত আমার বিয়ে! মা শেতলার দিব্যি, একবার জামাই হতে দিন, একটা আস্ত ‘জামাইকামঙ্গল কাব্য’ লিখে ফেলবো স্বপ্নাদেশ পেয়ে। কিন্তু, স্যার, আপাতত আমার বিয়েটা!
তা সেসব ঝুট ঝামেলা পেরিয়ে আমি জামাই হলাম। ফি বছর সুগন্ধী মেখে শ্বশুরবাড়ি যাই। শাশুড়ি মা হাতে হলুদ সুতো বেঁধে দেন। বাঁশপাতা, কাঁচা খেজুর, করমচা ডাল দিয়ে তালপাখার জলভরা বাতাসে কী আটপৌরে স্নিগ্ধতা লেগে থাকে। অন্য বাড়িতে আমার মা অনুপস্থিত ছেলে-বউমা’র নামে বাড়ির দরজায় দই-হলুদের ফোঁটা দেয়। আর বিমল দাসের ছবির মতো আমার শ্যালিকার ছেলে ওই ছোট্ট বদমাশটা, শান্ত হয়ে কোলে কলার কাঁদি নিয়ে বসে থাকে নতুন বইয়ের গন্ধ পাবে বলে। আমার জামাইষষ্ঠী মন্দ কাটে না।
এবছর আবার ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ জামাইষষ্ঠী পড়েছে। ভেবেছিলাম বউকে কালিম্পং পাঠিয়ে দেব। লকডাউন বলে যেতে পারেনি। যাগ্গে, অন্তত পাশের ঘরে থাক্। ‘পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল/ কই গো কই মেঘ উদয় হও’ বলে ফুকরে উঠছিলাম। শাশুড়ি মা শুনতে পেয়ে বললেন, হ্যাঁ এবার কই মাছই করব, তুমি তো পছন্দ করো। আমার ‘মেঘদূত’ পুরো উদয় চোপড়া বনে গেল। গাল ফুলিয়ে বসে আছি, শ্বশুরমশাই স্যারকে শুধোলাম, এবার ষষ্ঠীতে কী নেবেন, বলুন।
ভদ্রলোকের বাড়িতে আলাপ-পরিচয়ের শুরুর দিকে যখন যেতাম, শুনলে অবাক হবেন, কলেজ পড়ুয়া আমার থেকে গুচ্ছের খিস্তি শুনতেন। অভিধান লিখছিলেন তো, বললাম না আগে? খিস্তির অভিধান। তার সমাজভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন। বিচিত্র কঠিন সব তত্ত্ব। ইয়াব্বড়ো বড়ো সব অদ্ভুত বিষয়ের ডিকশনারিতে বাড়ি ভর্তি। আমি রোজ সকালে কাঁড়ি কাঁড়ি ব্যায়াম করি। মাঝে মাঝে ওই সব ডিকশনারি নিয়েও পেশির এক্সারসাইজ করি। স্যার, ওই গালিগালাজের অভিধানের জন্য নিয়ম করে সেসব খিস্তির অর্থ, প্রয়োগ আমার থেকে শুনে নিতেন। ছাত্রের আগ্রহে লিখে রাখতেন, দেখতাম। একজন দক্ষ শল্য চিকিৎসক যেন। কোনো ঘেন্না নেই, সংস্কার নেই। শুধু শব্দ আছে। যেখান থেকে পাওয়া যায়, আগলে তোলা শব্দ। হবু জামাইয়ের থেকেও শব্দ কুড়িয়ে নেওয়া। আর, আমি একজন গবেষককে দেখতাম চোখ ভরে।
তো শ্বশুরমশাই স্যারকে শুধোলাম, কী নেবেন স্যার এবার ষষ্ঠীতে?
বললেন, ‘বইটার নতুন এডিশন বেরোচ্ছে। অনেকদিন তো নতুন খিস্তি দাও না। দু-চারটে ভালো খিস্তি দিও আমায়। আছে?’
Powered by Froala Editor