শ্বশুরমশাইয়ের চোয়াল নাকি ‘ঘোড়ার মতো দীর্ঘ’, হিসেব কষে ষষ্ঠীতে যেত জামাই

ছোটোবেলায় নিজের বাবাকে প্রথম জামাইরূপে সকলেই প্রায় আবিষ্কার করে থাকেন মামার বাড়ি, মানে মায়ের বাপের বাড়িতে। আর বোন-তুতো বোনদের সংখ্যা বেশি হলে জামাই ষষ্ঠী নামক পাব্বনটি কেমন মহাযজ্ঞে পরিণত হয়, তার অভিজ্ঞতা আমারও কমবেশি বাল্যকালের স্মৃতি। নিজের পিতৃদেব সহ কত রকমের জামাই যে দেখেছি এই বিশেষ দিনে!

আসলে সারা বছর কালেভদ্রে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বা নিত্যযাত্রী জামাই ঘরের ছেলে টাইপ, কিংবা তাবৎ ঘরজামাই যেই হোক না কেন, এই বিশেষ দিনটিতে প্রত্যেকের ব্যবহারেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সারা বছর যিনি ডাকাবুকো দারোগা মেজাজের জামাই এদিন তিনিও খানিক বিনীত হয়ে আপিসে হাফ-ডে কপালে ফোঁটা নিয়ে ছাল-আঁটি ছাড়ানো আমের আঁশ গোঁফে মেখে থ্রিলারের সম্ভাব্য হত্যাকারীর মতো অপেক্ষা করেন। এরা সচরাচর নিয়তিবাদী হন, অর্থাৎ বউ অথবা শ্যালিকাদের স্পাই হিসেবে ব্যবহার করেন না রান্নাঘরের পরিবেশ সম্পর্কে আগাম জানান পেতে। ভালো ছাত্রও বটে, কেননা সম্ভাব্য প্রশ্নর আকস্মিকতা নিয়ে কোনো ধানাইপানাই নেই, নেই টুকলির বাসনা, কেননা এরা চ্যাম্পিয়ন, যে কোনো কোশ্চেন পেপারই সেট হোক না হোক, এরা উত্তর দিতে গিয়ে একস্ট্রা পাতা নেবেই। তাই আগের বছর রাতে পরোটার সঙ্গে পাঁঠার দোপেয়াজার পরিবর্তে যদি পাতে গরম ভাতের সঙ্গে রুই পোস্তও পড়ে, এরা বিস্মিত হন না। এরা যে কোনও পরিস্থিতিতেই নিজস্ব আস্তিনটুকু এই বিশেষ দিনটিতে হালকা বিনীত রেখে মগ্ন চৈতন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন উত্তরপত্র তথা পাতে। তবে ভালো ছাত্র হওয়ার দরুণ সচরাচর এরা নিজের পাকস্থলির পরিমিতি এবং শ্বাশুড়ির প্রত্যাশা সম্যক ভাবে জ্ঞাত, এবং নিয়ে-ফেলে অন্নকে পাতে মারেন না।

আরেক প্রজাতির জামাইয়ের  উদ্ভব বাসনা এদিন নিকষিত হয়, যারা বিভিন্ন বিষয়ে উদাসী কিন্তু পেটরোগা জামাই। এদের ব্যবহার সদ্য পুলিশ ডিউটিতে যোগ দেওয়া কনস্টেবলের মতো। সাড়ে সাতশো দইয়ের হাঁড়ির বেঁধে দেওয়া দড়ির সুতলি বাঁ-হাতে ধরে, অন্যহাতে লোকাল ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে যেনতেন ‘মার্ডার স্পট’ তথা শ্বশুরালয়ে পৌঁছনো এক ভিন্ন জাতের জামাই। এরা প্রায় তিনমাস আগে থেকে কচি শ্যালিকা বা বালক শ্যালককে নিজস্ব ‘খবরি’ হিসেবে প্ল্যান্ট করেন এই বিশেষ দিনটি নিয়ে শ্বশুড়-শাশুড়ির প্ল্যানিং সম্পর্কে আগাম হদিশ পেতে। নিজের ঘরণীকে আদৌ বিশ্বাসযোগ্যের তালিকায় ফেলেন না। আর ‘মার্ডার স্পটে’ গিয়ে ‘প্রতারক’ শ্যালক-শ্যালিকা নয়, নিজের বৌ-য়ের কাছেই জানতে পারেন সাদা ভাতের পরিবর্তে সর্ষে-ইলিশ, ইত্যাদির সঙ্গে নাদান শ্বাশুড়ি তার পাশের বাড়ির সখি নয়, সহেলির পরামর্শে জিরা রাইসের বন্দোবস্ত করেছেন এবং যাতে ভাতের চেয়ে ঘি বেশি থাকবে। এই প্রজাতির জামাইদের পাতের প্রতি তাকালে পুববাংলার সেই কুট্টিদের রসিকতা মনে পড়ে যায়, মশায়, ঘোড়ায়ও হাসবো। এরা নিজের কানকে হাত দিয়ে ঢেকে রেখে বর্ডার বাঁচানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ শ্যালিকার পাল্লায় পড়ে প্ররোচিত হয়ে ঘি-ভাতের সঙ্গে মাছের মাথার ঘি মেখে খেয়ে চোরা অম্বল নামক ‘চম্বলবাসী’-র হাতে শেষরাত পর্যন্ত অর্ধমৃত থেকে গাড়ু হাতে আত্ম সম্বিৎ-এ ফেরেন, তাদের প্রকৃত চরিত্র সম্বিত বসু তো দূর, ভাগবত প্রণেতাও উদ্ঘাটন করতে পারবেন না। 

এর পর আসবেন ছকু জামাইয়ের দল। যাঁরা কোনো স্পাই নয়, কেবল নিজস্ব অনুমান প্রক্রিয়ার ওপর ভরসা করে ছক করেন। অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির ওপর নজর রাখেন। এমন এক সাট্টাবাজ জামাইয়ের সঙ্গে একবার রুবির মোড়ে একদা আলাপ হয়েছিল, যাঁর শ্বশুরের আবার ঘোড়া-রোগ মানে রেসকোর্স আর কি। দু-দুটো ছোটো গোল্ড ফ্লেক খাওয়ার পর সে ব্যাটা বয়ান দিয়েছিল, তার শ্বশুরর জামা থেকে ঘোড়ার গন্ধ ছাড়ে। এমনকি বডি শেমিং কমেন্ট হলেও সে বলেছিল, তার শ্বশুরমশায়ের চোয়াল নাকি ঘোড়ার মতোই দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তারও জামাইষষ্ঠী ছিল। সে খবর রাখত, তার বৌয়ের বাবা কত টাকা হারল বা জিতল। সে ছকে নিত, সেবার এই দিনে কত দামের মিষ্টি বা মাছ নিয়ে ঢুকবে। তার বৌয়ের ছিল রক্তাল্পতা - অথচ সে বেচত ফল।  

ইসমাইল গত বছর বলেছিল, তার বৌ গৌরীকে ভর্তি করতে হবে কোথাও, রক্ত দিতে হবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমি যখন হাফ-ডে নিয়ে যাচ্ছিলাম শ্বশুরবাড়িতে, সেও যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিল। তার কাছে জামাইষষ্ঠী মানে টিফিনবক্স ভর্তি করে বৌ-য়ের জন্য খাবার যোগাড় করে আনা। খেলে বৌটা যদি একটু রক্ত পায়। 

Powered by Froala Editor