পাগলের মতো চ্যাপলিনের ছবি দেখতাম। এক-একটা ছবি আটবার দশ বার করে। তাঁর অভিনয়ের প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি মুভমেন্ট গুলে গুলে খেতাম।
বলেছিলেন জহর রায়। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতা। শুধু কি তাই? সিরিয়াস চরিত্রেও তাঁর অভিনয় অসামান্য। দোসর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, জহরের অন্যতম শক্তি ছিল তাঁর ফিজিক্যাল ফিটনেস। অনেক সিনেমায় তার প্রমাণও দিয়েছেন জহর। একসময় উত্তম-সুচিত্রা জুটির পাশাপাশি উচ্চারিত হত ভানু-জহর জুটির নাম।
আরও পড়ুন
জেলবন্দি অনন্ত সিংহকে মেয়ের বিয়ের ভোজ পৌঁছে দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
জহরের প্রথম সিনেমায় সুযোগ পাওয়াও চার্লি চ্যাপলিনের দৌলতেই। চ্যাপলিনের অন্ধ ভক্ত জহর অন্যান্য জীবিকা ছেড়ে, অভিনয় করবেন বলে চলে আসেন কলকাতায়। সেটা ১৯৪৭ সাল। পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘পূর্বরাগ’ সিনেমাটি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সটান তাঁর কাছে হাজির জহর। অডিশনে জহর চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর পার্ট করলেন। আর তাতেই পেয়ে গেলেন সিনেমায় সুযোগ। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
দশ বছরেরও বেশি সময় পর, একটি সিনেমায় জহরের অভিনয়ে আবার চার্লি চ্যাপলিনের ছায়া দেখা গেল। পুরো সিনেমায় নয় অবশ্য। বলা ভালো, সিনেমার একটি গানে। যদিও, শেষ পর্যন্ত চ্যাপলিনের প্রভাব ছাপিয়ে অনন্য হয়ে উঠেছিল জহরের নিজস্ব অভিনয়ই। ভানু-জহর জুটি তখন প্রবল জনপ্রিয়। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পেল ‘ভানু পেলো লটারী।’ এই সিনেমারই একটি গানে লিপ দিয়েছিলেন জহর রায়। সারা জীবনে হাতেগোনা কয়েকটিমাত্র গানেই লিপ দিয়েছিলেন তিনি। সেগুলির মধ্যে অন্যতম এই গানটি। অথচ গানটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা শোনা যায় না কোথাও। একই সিনেমায়, ভানুর লিপে ‘পুতুল নেবে গো’ গানটির সঙ্গে অবশ্য পরিচিত অনেকেই।
জহরের লিপে গানটি ছিল ‘ব্রহ্মা যখন দাঁড়িপাল্লায়’। লিরিকটি অদ্ভুত। যেন জহর রায়কে মাথায় রেখেই লেখা হয়েছে গানটি। চিত্রায়ণেও গানটির ভাব দারুণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন জহর। গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুরকার নচিকেতা ঘোষ ও গায়ক শ্যামল মিত্র।
‘ব্রহ্মা যখন দাঁড়িপাল্লায়
তোমায় আমায় তুলল ভগবান।
আমার চেয়ে তোমার ওজন
বেশি কি, সমান সমান।
...
ঠাকুর তুমি পল্কা
তোমার ওজন হাল্কা
তাই তো তুমি তুড়ি লাফে
পৌঁছে গেলে আসমান।
...
যতবার মনে করি
প্রভু আমি যে তোমায় গড়ি
তাই তো আমি তোমার চেয়ে
অনেক শক্তিমান।’
আজকের ধর্মীয় উগ্রতার যুগে এই গানটি প্রকাশ্যে এলে কী প্রতিক্রিয়া হত, বলা শক্ত। সেন্সর বোর্ডের ছাড় পাওয়া যেত কিনা, সেটাও বড় প্রশ্ন। কিন্তু মজার এই গানটি সেদিন কোনো বিরোধিতার মুখেই পড়েনি। বরং অসামান্য অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে গানের কথাগুলিকে আরও হাস্যকর করে তুলেছিলেন তিনি। শ্যামল মিত্রের গায়কীও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল। হ্যাঁ, বাঙালির উদারতা ও রসবোধ এমনই ছিল যে, চলচ্চিত্রতে ঠাকুর-দেবতাদের নিয়ে হাসিঠাট্টাও মজা হিসেবেই দেখত তারা। ভাবুন তো, 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' সিনেমাটি এখন মুক্তি পেলে, কী প্রতিক্রিয়া হত?
গানটির শেষ প্যারাগ্রাফে, গৌরীপ্রসন্নের লেখায় ছোঁয়া পাওয়া যায় আবহমান সেই উচ্চারণের – ভক্তের জন্যেই ভগবানের অস্তিত্ব। অথচ গভীর এই অংশটিও অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল শ্যামল-জহরের কৌতুকে। পাশাপাশি, গানটি শেষ হওয়ার পরেও, শ্রোতাদের হাততালির উত্তরে জহরের প্রতিক্রিয়া - কোনো তুলনাই হয় না তার!
দেখুন জহর রায়ের সেই অভিনয়
‘ভানু পেলো লটারী’ সিনেমাটি দেখেছেন অনেকেই। সেই সূত্রে গানটিও শুনেছেন। কিন্তু মনে রাখেননি বেশিরভাগ জনই। জহরের অভিনয়ের এক অসামান্য প্রতিভা ধরা রয়েছে এই গানটির দৃশ্যায়নের মধ্যে। গুরু চ্যাপলিনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য? হয়তো বা!