‘যোগ্যতাহীন অপদার্থ’, জাত নিয়ে আক্রমণের শিকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা

আজও সমাজের প্রতিটা স্তরে সবসময় বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় ‘বর্ণহিন্দু’ পরিচয়ের বাইরে থাকা মানুষদের। আদিবাসী হোক বা দলিত সম্প্রদায়, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য এখনও নিত্যসঙ্গী। এমনকি সাংবিধানিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা কিছু প্রশাসনিক সুবিধা এনে দিলেও সামাজিকভাবে সেটাই হয়ে ওঠে বৈষম্যের আরেকটি হাতিয়ার। ঠিক এমন ঘটনাই সম্প্রতি ঘটেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষিকা ড. মেরুনা মুর্মুর সঙ্গে।

২ সেপ্টেম্বর, সামাজিক মাধ্যমে ইউজিসি-র পরীক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশিকার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিলেন ড. মেরুনা মুর্মু। তাঁর বক্তব্য ছিল, একটি বছরের পরীক্ষার থেকে ছাত্রছাত্রীদের জীবনের দাম অনেক বেশি। তাই পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে এই ধরনের বাধ্যবাধকতা ঠিক নয়। এই মতকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাঁর বিরুদ্ধে হাতিয়ার করা হচ্ছে তাঁর জাতিপরিচয়কেই। বেথুন কলেজের বাংলা বিভাগের এক ছাত্রী সেখানে মন্তব্য করেছেন, “এখানে হয়তো ‘কোটা’ আর ‘আনকোটা’র তফাৎ।” অধ্যাপিকার সম্বন্ধে তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘জাতের দৌলতে আগে আসা কিছু যোগ্যতাহীন অপদার্থ’।

শিক্ষক দিবসের ঠিক আগে এমন একটি ঘটনায় আজকের সমাজেও জাতিবৈষম্যের নগ্ন চেহারাটাই উঠে আসছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস-কমিউনিকেশন বিভাগের ছাত্রী কুসুমিতা চক্রবর্তীর কথায়, “ছাত্রছাত্রী সমাজের অংশ হিসাবে আমরা লজ্জিত এবং মেরুনা ম্যাডামের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী সংসদ থেকে উক্ত ছাত্রীর প্রতিবাদে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক সংগঠনগুলির আশ্চর্যজনক নিরবতা তাঁদের অবাক করেছে। অন্যদিকে বেথুন কলেজের ছাত্রছাত্রী কমিটি থেকেও উক্ত ছাত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করা হয়েছে এবং মেরুনা মুর্মু সহ দেশের সমস্ত আদিবাসী ও দলিত পরিচয়ের মানুষের প্রতিদিনের লড়াইতে পাশে থাকার কথা বলা হয়েছে।

এই বিষয়ে ড. মেরুনা মুর্মুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “আসলে এখনও সমাজের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতার অভাব। রিজার্ভেশন পলিসিকে এখনও অনেকে পাইয়ে দেওয়া সুবিধা বলে মনে করেন। তাঁদের কাছে সামাজিক ন্যায়ের যুক্তি হাজির করা হয়নি এখনও।” প্রসঙ্গত, অধ্যাপনার পাশাপাশি সমাজে জাতি-বৈষম্য বিরোধী লড়াইতে সবসময় উপস্থিত থেকেছেন মেরুনা মুর্মু। এর আগেও তাঁকে এইধরনের কটুক্তির মুখে পড়তে হয়েছে একাধিকবার। এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও হেনস্থার শিকার হয়েছেন ইতিপূর্বে। তবে তাঁর কথায়, এখন যাদবপুর বিষ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি সংবেদনশীল। ধীরে ধীরে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুন
প্রয়াত সমাজকর্মী এবং লেখিকা ইলিনা সেন, থেমে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ

অন্যদিকে জাতিবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে মেরুনা মুর্মুর দীর্ঘদিনের সঙ্গী তথা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মহীতোষ মণ্ডল মনে করছেন, “মেরুনাদি একাই ভিকটিম নন। যে ছাত্রী তাঁকে এভাবে আক্রমণ করেছেন সেও এই সমাজের অশিক্ষার ভিকটিম।” তিনি আরও বলেন, “এই দেশে এমন কোনো এসসি/এসটি ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক বা কোনো মানুষ উপস্থিত নেই যাঁদের জাতিবৈষম্যের শিকার হতে হয় না। কেউ কেউ নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন নন। তাঁরা পুরো বিষয়টা মেনে নেন। তাঁদের উপরে আক্রমণের প্রভাব অনেক মৃদু। অন্যদিকে এই সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই আরও শক্তিশালী আক্রমণ নেমে আসে। মেরুনাদির মতো মানুষ নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যান বলেই তাঁকে বারবার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়।” প্রসঙ্গত, কিছু বছর আগে মহীতোষ মণ্ডলকেও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়েছে একাধিকবার।

তবে এর মধ্যেও নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার জেদ ধরে রেখেছেন মেরুনা মুর্মুর মতো মানুষরা। এই শিক্ষাব্যবস্থায় আগামী দিনে যাতে নিরাপদ থাকতে পারেন চুণী কোটাল বা রোহিত ভেমুলারা, তার প্রস্তুতি নিতে হবে আজকে থেকেই। সমাজকে বদলাতে না পারলে সাংবিধানিক অধিকারে আদৌ বেঁচে থাকার নিরাপত্তা পাবেন না কেউই।

আরও পড়ুন
পেশা চা বিক্রি, লকডাউনে দুঃস্থদের জন্য রাঁধতে আগ্রহী যাদবপুরের ‘শ্যামলদা’

Powered by Froala Editor

Latest News See More