যাদবপুরে শুরু সাঁওতালি বিভাগ, কলকাতায় প্রথম পাঠ্য হল উপজাতি ভাষা

দেড়শো বছরেরও বেশি সময়ের লিখিত ইতিহাস। কথিত তারও বহু আগে থেকেই। প্রাচীন ভারতের অন্যতম উপজাতি ভাষা সাঁওতালি। তবে প্রান্তিক উপজাতি ভাষা হওয়ায় এই ভাষার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র জেলা স্তরেই সীমিত। কলকাতার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এতদিন সুযোগ ছিল না সাঁওতালি ভাষার পঠন-পাঠনের। তবে এবার থেকে শতাব্দীপ্রাচীন এই ভাষার ক্লাস নেওয়া যাবে কলকাতাতেই। সম্প্রতি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। চালু হল সাঁওতালি ভাষার বিভাগ।

বিদ্যাসাগর, বর্ধমান এবং পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল শিক্ষার সুযোগ ছিল সাঁওতালি ভাষার। যাদবপুর বিশবিদ্যালয়েও এই ভাষার বিভাগ খোলার জন্য গত বছর থেকেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি নেওয়া। রাজ্য শিক্ষা দপ্তরে সাঁওতালি ভাষার বিভাগ খোলার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তারও বেশ কিছু বছর আগে থেকেই এই দাবি জানিয়ে আসছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলি। সেই দাবিই পূর্ণতা পেল সম্প্রতি।

“সাঁওতাল কমিউনিটি থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রীই পড়াশোনা করতে আসে যাদবপুরে। কিন্তু একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তো থেকেই যায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ যে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে সে জায়গায় একটা ব্রিজ স্থাপনের কাজ এই বিভাগের মাধ্যমে হবে। তা নিঃসন্দেহে। একটা ডিপার্টমেন্ট খোলা মানে তো শুধুমাত্র কোর্স তৈরি করা নয়। বৃহত্তর অর্থে তা ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছানো থেকে শুরু করে সেই ভাষার ধারাবাহিকতা, বৈচিত্রকেই তুলে ধরা। এবং যেখানে সারা ভারতে শিক্ষার সুযোগ যে কমছে, সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এখানে সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষার নতুন পরিসর তৈরি হচ্ছে। সেটা ছাত্রছাত্রীদের কাছে এক বড় জয়-খবর”, জানালেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গৌরব দাস। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র রাণা পালের জানান, “আমাদেরই ক্লাসের সাঁওতাল কমিউনিটির অনেক স্টুডেন্ট এই দাবি তুলেছিল। বাকিরাও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম সকলে। আসলে সাঁওতালিও তো একটি মাতৃভাষা। তেমন ছাত্রছাত্রীদের অধিকারটাও আছে নিজেদের মাতৃভাষায় উচ্চস্তরে শিক্ষা পাওয়ার। বাংলা, ইংরাজি বা অন্যান্য ভাষার মতোই। এবং এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় বাংলা আগ্রাসনও কাজ করে থাকে। মানে বাংলাতেও যে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে তা ভুলে যাওয়া হয়। সাঁওতালি ভাষার ওপরেও যে আগ্রাসন চলে, সেই বিরোধটা সমানভাবেই করা উচিত। সেখান থেকেই উঠে এসেছিল এই দাবি। 

তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও ঠিক করে ওঠেনি আসনের সংখ্যা এবং অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের নাম। বিষয়টি আলোচনার স্তরেই রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এই বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বছর কয়েক আগেই রাজ্যের সরকারি স্তরেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে সাঁওতালি। ‘সেট’, ‘নেট’ প্রভৃতি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রও প্রকাশিত হয় এই ভাষাতে। তাছাড়াও দ্বাদশ শ্রেণীর উচ্চমাধ্যমিকেও সাঁওতালি ভাষায় প্রশ্নপত্র হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু তারপর উচ্চশিক্ষার স্তরে সেইভাবেই কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে সত্যিই? অন্তত কলকাতা এখনও অবধি পিছিয়ে ছিল সেই ক্ষেত্রে। সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সাঁওতালি ভাষার উচ্চশিক্ষার পরিধি। প্রান্তিক বাংলার অনেক ছাত্রছাত্রীকেই নিজের পছন্দের ভাষা ছেড়ে বেছে নিতে হত অন্য বিষয়। এবার পরিসমাপ্তি হবে তারই। অন্যদিকে স্কুলস্তরেও সাঁওতালি ভাষার শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও যে বড়-সড় অবদান রাখতে চলেছে এই উদ্যোগ, তা বলাই বাহুল্য। এই নতুন বিভাগের দৌলতে কলকাতা ও শহরতলির পড়ুয়াদের মধ্যেও বাড়বে সাঁওতালি ভাষার চর্চা...

আরও পড়ুন
‘যোগ্যতাহীন অপদার্থ’, জাত নিয়ে আক্রমণের শিকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা

Powered by Froala Editor