আধপেটা খেয়েও রূপকথার ইস্কুল গড়েছেন লালমাটির দেশের সাঁওতালি ক্ষেতমজুররা

 ভোরের আলো ফুটলেই জীবনের সাইরেন যেন খিদের তাগিদে ঘর থেকে বের করে ওঁদের, তারপর সারাটাদিন মাঠে-মাঠে বীজ বহাল টেনে সন্ধ্যা নামার আগে ঘরে ফেরেন তাঁরা। সারাটা দিন কেটে যায় ক্ষেতমজুরিতেই। পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম ১ নং ব্লক ও দিগনগর ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের  যাদবগঞ্জ গ্রাম। এই গ্রামের ৭৫ শতাংশ মানুষই সাঁওতালি ক্ষেতমজুর। খিদের পাতে খাবার হয়তো জোটে কিন্তু তা পর্যাপ্ত না, মাথার উপর ছাদ হয়তো আছে কিন্তু বৃষ্টির দিনে অনিদ্রায় প্রহর কাটে। সরকারি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কিন্তু সেখানেও পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। বর্ষার রাতে মা মনসাই একমাত্র ভরসা, হেপাটাইটিসে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া যে-কোনো রোগীর প্রধান উপশম মারাংবুরু। নিজের নামখানিও লিখতে পারেন না ৮৫ শতাংশ মানুষ।

এমন এক সাঁওতালি গ্রাম অধ্যুষিত লাল মাটির রাস্তা বেয়েই শাল আর মহুয়ার কোলে অবস্থিত যাদবগঞ্জ আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়। আধুনিক শিক্ষাপ্রচার, স্বচ্ছ বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নগত পরিসংখ্যান অন্তত তেমনই চমক দেওয়ার মতো। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এই স্কুলে এখন ৩৫০ জন ছাত্রছাত্রী। যার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যার ছাত্রছাত্রীরা ওই পিছিয়ে থাকা সাঁওতাল পল্লি থেকে উঠে এসেছে। বর্তমান প্রধান শিক্ষক বিজন রানা এবং অনান্য শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসাবে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পালক জুটেছে এই বিদ্যালয়ের মুকুটে। স্বচ্ছ বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাগত সরকারি ক্ষেত্রে অনেকগুলি পুরস্কারের সোনার পালক অর্জন করেছে এই বিদ্যালয়। যা এই রাজ্যের অনেক নামকরা বিদ্যালয়ও অর্জন করতে পারেনি।

আরও অবাক হতে হয় এই বিদ্যালয় সৃষ্টির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে। সে অনেক আগেকার কথা, সম্ভবত ১৯৮৫ সাল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খিদের ভাত জোগানো সাঁওতালী ক্ষেতমজুর মানুষগুলি একদিন স্বপ্ন দেখলেন অন্ধকার নিবারণের। আর তার জন্য গঠন করতে হবে স্কুল, স্কুলে ক্লাস। ছোটকা সরেন, লকু হেমব্রমরা কোদাল কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শুরু হল স্কুল তৈরির কাজ। একটা-দুটো করে মাটির দেওয়াল উচুঁতে উঠতে উঠতে ছাদের প্রয়োজন হল, তালপাতা কেটে মাটির চার দেওয়ালের উপর ছাদ তৈরি হল।

উল্লেখ্য যে, লকু মুর্মু, একজন নিরক্ষর সাঁওতাল ক্ষেতমজুর, প্রথম উপলব্ধি করেন যাদগঞ্জের বুকে শিক্ষা সম্প্রচারের জন্য বিদ্যালয় তৈরি করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, সেই বিদ্যালয় তৈরি করতে দিনমজুর এই মানুষটি নিজের সবটুকু জমিও দান করেন। সে-সময় যাদবগঞ্জের অনেক মানুষই নিজেদের জমি দিতে রাজি হননি। লকু নিজের সবটুকু জমি দান করে বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। নিজে কিন্তু এখনও ক্ষেতমজুরের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।                       

প্রাথমিকভাবে কিছু ছাত্রছাত্রী জোগাড়ের পর, গ্রামের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ব্যক্তিদের আহ্বান জানানো হয় ক্লাস নেওয়ার জন্য। শুরু হল স্কুল। সেই যে শুরু হল, পথচলা আর থামেনি। মাটির দেওয়াল ভেঙে পরবর্তীকালে তৈরি হল ইঁটের দেওয়াল, সরকার স্বীকৃতি দিল, অনুদান এল, প্রসারিত হল বারান্দা। নলকূপ হল, বাথরুমও...।

বড় হতে হতে আজ স্কুলটিতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হয়। স্কুল পরিচালন কমিটির অধীনে সরকারি কর্মচারী রয়েছেন ২৬ জন। ব্যবস্থা আছে মিড-ডে মিলেরও। রয়েছে হোস্টেল, বিশুদ্ধ পানীয় জল, খেলার মাঠ, কম্পিউটার ক্লাসরুম, সৌরশক্তি প্রচলিত আলো, ঝাঁ-চকচকে ক্লাস, স্কুলের মাঠে রঙবেরঙে বাহারি ফুলের বাগান। ছাত্রছাত্রীরা আর আদুর গায়ে ঘোরে না, অসুস্থ হলে ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে যায়।

শূন্য থেকে শুরু করে এই অর্জন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। গ্রামটির মানসিকতাই বদলে দিয়েছে যাদবগঞ্জ আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়। চৌত্রিশ বছর আগে কয়েকজন গরিব গ্রামবাসী যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ তা অনেকাংশেই সফল। শিক্ষা যখন এভাবে আলো নিয়ে আসে, তখনই বিশ্বাস জাগে ভালো-র প্রতি। বাংলার মানচিত্রে শিক্ষার লড়াইয়ের অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকুক এই স্কুল।

More From Author See More