বাস্তবের ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’, আকারে বড়ো শনির থেকেও

মহাবিশ্বের কতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছে মানুষ? সৌরজগৎ পার করে যে অসীম শূন্য হয়েছে, তার খোঁজ চলছে অবিরত। পাওয়া যাচ্ছে নিত্যনতুন গ্রহ-নক্ষত্রের সন্ধান। আর বাড়ছে বিস্ময়ের পরিধি। পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কিনা, আজও পাওয়া যায়নি নিশ্চয়তা। কিন্তু দেখা মিলেছে আরেকটি শনি গ্রহের। একইভাবে চারদিকে সুদৃশ্য বলয় ঘেরা। তবে আয়তনে শনি গ্রহের প্রায় ২০০ গুণ।

২০০৭ সালে আমেরিকা ও নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায় পাওয়া যায় গ্রহটির সন্ধান। নাম রাখা হয়েছে জে১৪০৭বি (J1407 b)। এ কে ঘিরে আছে ৩০টি রিং বা বলয়। যার আপাত উজ্জ্বলতার মান ১২.৩। ফলে অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ ছাড়া এর দেখা মেলে না। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এর বলয়ের ব্যাপ্তি। গ্রহ থেকে কাছের বলয়টি রয়েছে ৩ কোটি কিলোমিটার দূরে। আর শেষতমটি ৯ কোটি কিলোমিটার দূরে। বিজ্ঞানীদের চোখে এত বিশালাকৃতির বলয় ঘেরা গ্রহ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। 

কীভাবে দেখা মিলল এর? বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই নজর রাখছিলেন মহাকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের উপরে। প্রজেক্টের নাম দেন ‘সুপারওয়াস্প’। তালিকায় ছিল ৪৩৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত জে১৪০৭ নক্ষত্রটিও। তাঁরা লক্ষ করছিলেন, কীভাবে নক্ষত্রের আলো কমে-বাড়ে। অন্য গ্রহদের ছায়ায় কীভাবে কয়েক ঘন্টার জন্য আংশিক ঢাকা পড়ে যায় তাদের আলো। কিন্তু জে১৪০৭-এর ক্ষেত্রে ঘটে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। 

২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নক্ষত্রটির সমস্ত তথ্য জোগাড়ের পরিকল্পনা করেন বিজ্ঞানীরা। ২০০৭-এর একসময়ে আলোকতরঙ্গ শুরু করে অদ্ভুত আচরণ। জ্বলতে থাকে জোনাকির মতো। এরকম দৃশ্যের সাক্ষী তাঁরা আগে হননি। প্রায় ২ মাস চলে এরকম ঘটনা। বিস্তারিত গবেষণায় জানা যায়, নক্ষত্রটির সামনে চলে এসেছিল একটি বিরাটাকারের গ্রহ। এরই নাম জে১৪০৭বি।

আরও পড়ুন
নিজেরই বলয় গিলে খাচ্ছে শনি!

নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। আলাদা একটি দল তৈরি করা হয় শুধুমাত্র এই গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাঁদের অনুমান, জে১৪০৭বি-র আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অনেক বেশি। প্রায় ১০০০ থেকে ২০০০ সেলসিয়াস। উষ্ণতার জন্য তৈরি হওয়া গ্যাস ও ধূলিকণার মিলিত উপাদান দিয়েই সম্ভবত তৈরি হয়েছে বাইরের বলয়গুলি। নিশ্চিত করে বলা হয়তো এখনই সম্ভব নয়। তবে এগুলি যে শনি গ্রহের মতো বরফের অংশবিশেষ নয়, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত। গ্রহটি আকারে বৃহস্পতির থেকে প্রায় ২৬ গুণ বড়ো। যদি সৌরজগতের শনিগ্রহের বদলে জে১৪০৭বি-কে রাখা হত, তাহলে রাজত্ব করত রাতের আকাশ জুড়ে। প্রতিটি বলয়কে স্পষ্ট দেখা যেত পৃথিবী থেকে। চাঁদের আলোকেও ফিকে মনে হত এর সামনে। আকারে বড়ো হলেও, বয়সে পৃথিবীর কাছে নিতান্তই শিশু। মাত্র দেড় কোটি বছর বয়স। সেখানে পৃথিবী তো প্রায় ৪৫০ কোটি বছরের বৃদ্ধ। 

আরও পড়ুন
শনির উপগ্রহে আগ্নেয়গিরির সন্ধান, জলের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণের সম্ভবনা

তাতেও অবশ্য সৌন্দর্য কমেনি জে১৪০৭বি-র। অনেকে এর নাম দিয়েছেন ‘বৃহৎ শনি’ (Super Saturn)। এ যেন সত্যিই ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’। হলিউডের বিখ্যাত সিনেমার নামকে কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করা যায় জে১৪০৭বি-র জন্য। আক্ষরিক অর্থেই রিংস বা বলয়ের রাজা এই গ্রহটি। তার অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য মন কেড়েছিল গবেষকদের। তারপরই হয়ে যায় নিখোঁজ। ফলে আবার শুরু হয়েছে বিস্তৃত তথ্য আবিষ্কারের কাজ। এভাবেই যেন বারবার মহাকাশের অপার বিস্ময় মানুষের সামনে মেলে দেয় কল্পনা ও বিজ্ঞানের মিলিত ডানা।

চিত্রঋণ: রন মিলার (Ron Miller)

Powered by Froala Editor