উনিশ শতকের শেষ দিক সেটা। কিংবা বিশ শতকের শুরু। ভারতে তখন ইংরেজদের রমরমা। পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ রাজত্বের অন্যতম ঘাঁটি এই দেশ। অবস্থানগত এবং পরিবেশগতভাবে ভারতীয় ভূখণ্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, গোটা দেশের পরিকাঠামো নিজেদের আদলে তৈরি করে নেওয়ার প্রকল্প নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু দরিদ্র দেশে শ্রমিক থাকলেও, প্রযুক্তিবিদের অভাব। ফলত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিটেন এবং অন্যান্য ইউরোপের দেশ থেকে প্রযুক্তিবিদদের আনা হত ভারতে। ঠিক সেভাবেই রেলপথ নির্মাণের কাজ নিয়ে ভারতে এসেছিলেন ইতালিয় স্থপতি। প্রথমে দক্ষিণ ভারতের আম্বাসামুদ্রাম, তারপর বদলি হয়ে চলে এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলায়।
জিউসেফ মারিনি। তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল হাওড়ার বালি ব্রিজ, অধুনা বাংলাদেশের নীলগিরি রেলওয়ে র্যা ক। তাছাড়াও বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথ নির্মাণের কাজেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল জিউসেফের। পাশাপাশি বাংলার সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল এক আত্মিক যোগও। এক বাঙালি রমণীর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁর রূপকথার প্রেম। তারপর বিবাহ। না, তাঁদের এই সম্পর্ক মেনে নেননি কেউ-ই। শেষ পর্যন্ত শহর বদল করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। ইতালির টাস্কানি শহরের এই স্থপতির কথা মনে রাখেনি বাঙালি। মুছে গেছে সময়ের সমস্ত দলিলও। সম্প্রতি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতা-ভিত্তিক একাধিক গ্রুপে ফের উঠে এল জিউসেফের কথা। নেপথ্য, তাঁর প্রপৌত্র আন্দ্রেয়া মারিনি। বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর শিকড়। আর সেই হারানো গল্প, প্রমাতামহের পরিচয় খুঁজে পেতেই মরিয়া সন্ধান চালাচ্ছেন তিনি।
আন্দ্রেয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁর প্রমাতামহ, কালী ছিলেন বাংলারই এক অভিজাত ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারের কন্যা। পরবর্তীতে অবশ্য নাম বদল করে তিনি ক্যাথরিন নাম নেন। ইতালিয় ভাষায় লিখিত নথিতে তাঁর বাবার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে রণজিৎ (মতান্ত্রে রঙ্গিত) হিসাবে। তবে তৎকালীন সময়ের ভারতীয় পরিচয়পত্রে কালী’র পিতৃপরিচয় লেখা ‘রাম শ্রীরিথা’ নামে।
এই তথ্যগত ভ্রান্তির সমাধান করতে আন্দ্রেয়া নিজেও একাধিকবার এসেছেন ভারতে। বাংলায়। তাঁর ব্যক্তিগত গবেষণা অনুযায়ী উনিশ শতকের শেষের দিকে, পশ্চিমবাংলার নশীপুরে রাজত্ব ছিল রণজিৎ নামের এক রাজার। তবে সেই রাজবাড়িতে যোগাযোগ করার পর বেশ হতাশ হন আন্দ্রেয়া। ফিরতে হয়েছিল খালি হাতেই। তাঁকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, সেই পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম ইতালিয় যোগ নেই। অন্যদিকে ‘শ্রীরিথা’ পদবিটির অস্তিত্বই নেই ভারতে। বরং, থাইল্যান্ডের এই নামে রয়েছে একটি মন্দির। কালী-র পরিবারের সঙ্গে থাইল্যান্ডের আদৌ কোনো যোগ ছিল কিনা, কিংবা থাই-রাজার থেকে তাঁরা এই পদবি উপাধি হিসাবে পেয়েছিলেন কিনা— সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন আন্দ্রেয়া।
কালীকে বিবাহের করার পরই, বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলা ছেড়েছিলেন জিউসেপ। ছেড়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের কাজও। বদলে ত্রিবান্দ্রম শহরে আশ্রয় নেন তিনি। ত্রিবান্দ্রম শহরে তাঁর বাসভবনই আজ কিংবদন্তি ম্যাসকট হোটেল। দক্ষিণে স্থানান্তরিত হওয়ার পর জিউসেপ ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা পদ্মনাভদাস তিরুনাল বলরাম বর্মার হয়েই পরবর্তীতে কাজ করতেন তিনি। দক্ষিণ ভারতের চেঙ্গান্নুর সেতু এবং ত্রিবান্দ্রম সিটি স্টেশনের নকসাও নির্মাণ করেন ইতালিয় স্থপতি। কালী এবং জিউসেপ সম্পর্ক যতটুকু নথি আন্দ্রেয়া পেয়েছেন, তা সবটাই এই শহর থেকে।
তবে আজীবন ভারতে কাটালেও, শেষ বয়সে সায় দেয়নি ভাগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি মুহূর্তে বদলে দিয়েছিল পরিস্থিতি। জার্মান এবং ইতালিয়রা তখন দু’চক্ষের বিষ ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। সেসময় ভারতে কর্মরত হাজার হাজার ইতালিয় নাগরিকদের গ্রেপ্তার করেছিল ব্রিটিশরা। সেই তালিকাতেই ছিলেন জিউসেফ। ১৯৪০ সালেই আটক করা হয়েছিল তাঁকে। তারপর ব্রিটিশ সরকারের চাকরি ছাড়ার কারণে সন্দেহভাজন ভেবে ক্রমাগত অকথ্য অত্যাচার চলেছে তাঁর ওপর। দীর্ঘ ৫ বছর দেরাদুনের ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি থাকার পর ১৯৪৫ সালে সেখানেই মারা যান জিউসেফ। ভারত নয়, বরং নেপালের কাঠমাণ্ডুতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে। সেই সমাধি রয়েছে আজও। তবে কালী-র শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তিনি কোথায়ই বা ছিলেন শেষ জীবনে— তার কোনো তথ্যই খুঁজে পাননি আন্দ্রেয়া। আজ থেকে হয়তো কয়েক দশক পর কালী-র পিতৃপরিবারের কোনো উত্তরসূরিও এই একই উত্তরের অনুসন্ধানে নামবেন। হয়তো সেদিন উন্মোচিত হবে ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায়। কিংবা চিরকালের মতোই অতীতের ধুলোয় ধামা চাপা পড়ে থাকবে রূপকথার এই খণ্ডচিত্র। একমাত্র সময়ই সমাধান খুঁজে দিতে আরে এই জটিল ধাঁধাঁর…
Powered by Froala Editor