ডুবোজাহাজ ‘নটিলাস’ চেপে সাত সমুদ্র ঘুরে বেড়াত সে। তিমি-ডলফিন-হাঙ্গরদের সাম্রাজ্যের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজের রাজত্ব। হ্যাঁ, কিংবদন্তি ফরাসি সাহিত্যিক জুলে ভার্নের সৃষ্ট ক্যাপ্টেন নিমো চরিত্রটির কথাই হচ্ছে। এবার পৃথিবীর খাদ্যাভাবের মোকাবিলা করতে নিমোর রাজত্বের মতোই সমুদ্রের তলদেশে এক আশ্চর্য বাগান গড়ে তুললেন গবেষকরা।
হ্যাঁ, সমুদ্রের তলদেশে শাক-সবজির চাষ। আসলে নগরায়নের ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক হারে কমছে কৃষিজমির পরিমাণ। তেমনই উষ্ণায়ন, খরা, অনাবৃষ্টির ফলেও কমেছে বহু ফসলের উৎপাদন। কয়েক বছর পর এই পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে উপায়? চাঁদ কিংবা মঙ্গলের মাটিতে আদৌ চাষ সম্ভব কিনা, তা নিয়েই ইতিমধ্যে গবেষণা শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে পৃথিবীর বাইরে উপনিবেশ স্থাপন এখনও মানুষের কাছে ইউটোপিয়ার মতোই। তাই বিকল্পের সন্ধান করতেই সমুদ্রের তলায় বাগান (Underwater Garden) তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিম ইতালির বাসিন্দা ও গবেষক লুকা গ্যাম্বেরিনি।
‘নিমো’স গার্ডেন’ (Nemo's Garden)। হ্যাঁ, জুলে ভার্নের তৈরি চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমোর নামানুসারেই এই বাগানের নামকরণ করেছেন লুকা। উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রথম সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত স্থলজ উদ্ভিদের বাগান ‘নিমো’স গার্ডেন’। কিন্তু কীভাবে তৈরি করা হয়েছে এই বাগানকে? কী ধরনের ফসলই বা উৎপাদন করা সম্ভব সেখানে?
উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় কৈশোর থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ লুকার। অবসর সময় কাটে স্কুবা ডাইভিং-এ। বছর দশেক আগের কথা। স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়েই সমুদ্রের তলায় বাগান তৈরির পরিকল্পনা করেন লুকা। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। পরীক্ষামূলকভাবে একটি বেলুনের মধ্যে তুলসী চারা রোপন করে তা সমুদ্রের তলদেশে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে এসেছিলেন তিনি। সমুদ্রস্রোতে এই বেলুন যাতে ভেসে না যায়, তার জন্যও করেছিলেন বিশেষ ব্যবস্থা।
সপ্তাহ খানেক বাদে এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে রীতিমতো চমকে ওঠেন তিনি। মারা যাওয়া তো দূরের কথা। দিব্যি বেচে আছে তুলসী গাছটি। প্রাথমিকভাবে এই পরীক্ষা সফল হওয়ার পরই পুরোদমে শুরু হয় গবেষণা। সমুদ্রের তলায় আস্ত বাগান তৈরির জন্য একাধিক নীল-নকশাও তৈরি করেছিলেন লুকা।
বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশে ২ মিটার ব্যাস-বিশিষ্ট কাচের স্বচ্ছ গম্বুজ আকার গ্রিন হাউস চেম্বার নির্মাণ করেই গড়ে তোলা হয়েছে এই বাগান। প্রতিটি গম্বুজই লোহার শিকল ও নোঙরের সাহায্যে আটকানো সমুদ্রের তলদেশের সঙ্গে। ফলে সমুদ্রস্রোত কিংবা ঝড়ে তা ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। লুকার কথায়, সমুদ্রের তলদেশের এই পরিবেশ স্থলজ উদ্ভিদদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আরও বেশি উপযুক্ত।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বিষয়টা সত্যি। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৬-১০ মিটার নিচে সূর্যালোকের তীব্রতা কমে যায় অনেকটাই। বাড়তে থাকা উষ্ণায়নের প্রভাব অনেকটাই কম সেখানে। ফলে, তীব্র তাপদাহ থেকে রক্ষা পায় শস্য ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। পাশাপাশি এই গম্বুজে ব্যবহৃত বিশেষ ফিল্টার নোনা জলকে পরিণত করে মিষ্টি জলে। ফলে জলাভাব, খরা কিংবা অনাবৃষ্টির মতো সমস্যা নেই এই বাগানে। অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে এই বাগানে ধান, গম চাষা করা সম্ভব হলেও, প্রতিবন্ধকতা এই বাগানের সীমিত আয়তন। কাজেই এইধরনের দানাশস্যের চাষ ততটাও লাভজনক হবে না নিমো’স গার্ডেনে। তবে টমেটো, মটরশুঁটি থেকে শুরু করে স্ট্রবেরি ও ভেষজ উদ্ভিদ-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফল ও সবজির চাষ ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন লুকা এবং তাঁর বাবা। মিলেছে সাফল্যও।
জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জেরে ক্রমশ প্রাকৃতিক সম্পদ কমে আসছে মানুষের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যসংকট মেটাতে এ-ধরনের ‘আন্ডারওয়াটার গার্ডেন’-ই অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠবে মানুষের, মনে করছেন লুকা। ইতিমধ্যেই এই বাগানের স্বত্বগ্রহণ এবং এহেন অন্যত্র বিভিন্ন জায়গায় বাগান তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেছে একাধিক মার্কিন সংস্থা। বলার অপেক্ষা থাকে না, এক আশ্চর্য ভবিষ্যতের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতা।
Powered by Froala Editor