করোনা সংক্রমণ লাগামহীন রাজ্যে, সাপ্তাহিক দু’দিন লকডাউনের সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত?

ভারতে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা কুড়ি লক্ষ ছুঁতে দেরি নেই আর। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পশ্চিমবাংলাতেও। দেশজুড়ে আনলক-৩ প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেলেও, বাধ্য হয়েই এখনো জায়গায় জায়গায় চালু রাখতে হয়েছে লকডাউন। এমনকি বেগতিক বুঝে সাপ্তাহিক লকডাউনের বিধিনিষেধও চাপানো হয়েছে নাগরিকদের উপর। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না করোনা সংক্রমনের হানা। প্রায় প্রত্যেক দিনই সংক্রমণের হারে তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। গত শুক্রবার রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী ২৪ ঘন্টায় সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার জন। সব মিলিয়ে রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা পার করে গিয়েছে ৭০ হাজারের গণ্ডি। ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যুও।

এই পরিস্থিতে গোষ্ঠী সংক্রমণের কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও, পশ্চিমবঙ্গে সাপ্তাহিক দু’দিন করে লকডাউন কার্যকর করার ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই লকডাউন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গোষ্ঠী সংক্রমণ আদৌ আটকানো যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গোষ্ঠী সংক্রমনের কথা আগেই স্বীকার করে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল সরকারের, সে কথা বারবারই উঠে এসেছে এই বিশেষজ্ঞদের কথায়।

রীতিমত খেদ প্রকাশ করে ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডক্টর সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ জানিয়েছেন, দেশ এবং রাজ্য সরকারগুলিকে মে মাসেই গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হওয়ার কথা জানানো হলেও কেউই সেটা মানতে চাননি। তার ফলে যা হবার, হয়েছে সেটাই। প্রত্যেকদিন সংক্রমনের নতুন শিখর ছুঁয়েছে কোভিডের হানা। এই প্রসঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধের প্রসঙ্গটিও টেনে এনেছেন তিনি। সাফ জানিয়েছেন, গোষ্ঠী সংক্রমণ স্বীকার না করলে গোষ্ঠী প্রতিরোধের ধারণাটিও ফিকে হয়ে যায়।

বরাবরই সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সবথেকে কঠোর ভাবে পালন করা হয়েছে লকডাউন। যদিও বাস্তবে অন্য ছবিই ধরা পড়েছে সর্বত্র। বিশেষভাবে লকডাউন পালনে শিথিলতা দেখা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ব্যাপক অংশে। নিয়মিত ভিড় দেখা গিয়েছে বাজারে দোকানে। সামাজিক সুরক্ষা বিধির নিয়ম উঠে গিয়েছে শিকেয়। মাস্ক নেমে এসেছে থুতনিতে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমনের হার নিয়ে ভয়াবহ আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স বা আইআইএসসির গবেষকেরা। একটি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে তাঁরা দেখিয়েছেন, যে হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ভারতে তাতে যদি অবিলম্বে রাশ না টানা যায়, তাহলে সেপ্টেম্বরে ভারতে মোট সংক্রমণের হার ছাড়িয়ে যাবে ২৫ লক্ষের গণ্ডি।

সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে এই সংক্রমণের হার ভেঙে দেওয়া সম্ভব বলে জানালেও, আইআইএসসির গবেষকদের মতে তার জন্য কয়েকটি কঠিন শর্ত মেনে চলতেই হবে মানুষকে। পশ্চিমবঙ্গের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি তাঁরা।

আইআইএসসির বিভাগীয় প্রধান ডক্টর শশী কুমার গনেশণ জানিয়েছেন, বিজ্ঞানভিত্তিক মডেলে লকডাউনের অর্থ শুধুমাত্র অফিস, স্কুল-কলেজ বা বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া নয়। বরং আক্ষরিক অর্থে লকডাউন বলতে বোঝায় যেখানে সব ধরনের সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলবেন সাধারণ মানুষ। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই সচেতন হবেন নিজেরা। সামাজিক মেলামেশার নিষেধ পালন করার সঙ্গে সঙ্গেই সামান্য সর্দি-কাশিতেও বাড়িতেও ব্যবহার করবেন মাস্ক। নিজেরাই দায়িত্ব নেবেন অন্যদের সুরক্ষিত রাখার। কিন্তু এতদিন এই সঠিক ধারায় লকডাউন পালন হয়নি বলেই দিনদিন বেড়েছে করোনা আক্রান্তের হার। এমনকি ‘পিক’ বা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছলে চিত্রটা যে আরও ভয়াবহ হবে, সেই আশঙ্কার কথাও শুনিয়ে রেখেছেন তিনি।

আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে

যদিও দেশজুড়ে কোভিড সংক্রমণের নিরিখে রীতিমতো ভয়াবহ জায়গায় ছিল যে জায়গাগুলি, তাদের মধ্যে সংক্রমনের হার কমেছে দিল্লী, মুম্বই ও আমদাবাদে। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বা এইমসের অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়া সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, দেশের এই তিনটি মেগাসিটি এবং দক্ষিণের কয়েকটি শহরে করোনা আক্রান্তের রেখচিত্র নামতে শুরু করেছে নীচের দিকে। কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টো কলকাতায়। গত ২৫ শে জুন যেখানে কলকাতা শহরে কোভিড পজিটিভ ছিলেন ১৩৪ জন, সেখানে একমাসের মধ্যেই সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে সাতশোর গণ্ডি!

ব্যাপারটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কলকাতার চিকিৎসক মহল। সংক্রমণ হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী শুধুমাত্র বয়স্ক মানুষেরাই আক্রান্ত হচ্ছেন না এই রোগে। বরং বিন্দুমাত্র উপসর্গ না থাকলেও করোনা পজেটিভ রোগীর সন্ধান মিলেছে অহরহ। এক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েছে আরও বেশি। কারণ, কোনও রকম শারীরিক সমস্যা না থাকায় লাগামহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এইসব মানুষেরা। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টেস্ট করা আবশ্যক ছিল বলে মনে করেছেন চিকিৎসকেরা। যদিও বাস্তবে বাড়ি বাড়ি নমুনা সংগ্রহ করে অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি টেস্ট হয়েছে নামমাত্রই।

দিল্লি, আমদাবাদ বা মুম্বইতে যে ফর্মুলায় সাফল্য এসেছে, সেই রোডম্যাপ এখনও দুরস্ত পশ্চিমবাংলায়। ব্যাপকহারে পরীক্ষা, আবাসন থেকে বস্তি এলাকায় সর্বত্র আক্রান্ত চিহ্নিত করে আইসোলেট করা, কড়া লকডাউন পালন করার সঙ্গে সঙ্গেই কঠোর নজরদারি— এই সকল পদ্ধতির মাধ্যমে সংক্রমণের হার কমানো গিয়েছে এই তিনটি মেগাসিটিতে। অথচ পরিকাঠামোর অভাবে পশ্চিমবঙ্গে নমুনা পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটার খবর সামনে এসেছে প্রায়ই।

আরও পড়ুন
করোনাকে সঙ্গী করেই কাটাতে হতে পারে জীবন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাপানিরা

এর সঙ্গেই বেড়েছে করোনা আক্রান্তদের প্রতি অন্যান্য মানুষের সহমর্মিতার অভাব। এক ধরনের সামাজিক ‘ট্যাবু’তে পরিণত হয়েছে এই উপসর্গ। ফলে রোগ চেপে রেখে কিংবা অসুস্থ লাগলেও অনেক সময়ই হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করতে ভয় পাচ্ছেন সাধারন মানুষ। এক্ষেত্রে একদমই দায় এড়াতে পারে না স্বাস্থ্য ক্ষেত্রও। সরকারি তরফে বারবারই ‘মানবিক’ হওয়ার অনুরোধ করা হলেও, সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীরাও পজিটিভ হতে পারে এই সন্দেহে সাধারণ চিকিৎসাটুকুও পাচ্ছেন না অনেকে। ফলে সাধারণ অক্সিজেনটুকু পেলেই কিছু ক্ষেত্রে বেঁচে যেত যে প্রাণগুলি, তাঁরাও নিতান্ত অবহেলায় ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে, নির্মম সেই ছবিও সামনে এসেছে একাধিক বার।

যদিও একটি কথা বারবারই শোনা গিয়েছে সমস্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মুখে। মহামারী মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হতে হবে সাধারণ মানুষকেও। তেতো ওষুধ গিলিয়ে দেওয়ার মতো করে কখনোই সফল করা যাবে না লকডাউন। বরং তাগিদটা আসতে হবে নিজের ভিতর থেকেই। সাপ্তাহিক দু’দিন লকডাউনের প্রক্রিয়াকে এই কারণেই সন্দেহের চোখে দেখছেন স্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পরীক্ষার সংখ্যা না বাড়িয়ে শুধুমাত্র লকডাউন করে বিশেষ লাভের লাভ কিছুই হবে না বলে বারবারই জানাচ্ছেন তাঁরা। এখনো অবধি পশ্চিমবঙ্গে অসুস্থ না হলে টেস্ট করা হচ্ছেই না বলে খেদ শোনা গিয়েছে বিশেষজ্ঞদের মুখে। 

এক্ষেত্রে উপায় কী? পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপকহারে পরীক্ষা এবং ‘ট্যাকটিক্যাল ইন্টারমিটেন্ট লকডাউন’ই করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার হাতিয়ার হতে পারে বলে মত এই বিশেষজ্ঞদের। তাই দোকানে বাজারে কিংবা রাস্তাঘাটে, বাসে লাগামহীন ভিড়ের ছবি যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই সাপ্তাহিক দু’দিন লকডাউন নিরর্থক বলেই ধরা দিয়েছে তাঁদের চোখে। সুতরাং পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, সঠিক সংখ্যা চেপে রেখে কিংবা রাজনীতি করে আখেরে লাভের লাভ হচ্ছে না কিছুই। বরং কথায় এবং কাজে ফারাক থেকে যাচ্ছে কয়েক যোজন। এই দূরত্ব যতক্ষণ না কমিয়ে আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ কোভিড যুদ্ধে এই লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারের মতোই।

আরও পড়ুন
প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করোনা-আক্রান্তের মৃত্যু রাজ্যে, উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য দপ্তর

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More