সাল ২০১৫, মার্চ মাস। এইচ এম আই এর মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সে, সেদিন সবে বেসক্যাম্পে পৌঁছেছি। চৌরী-কাং থেকে প্রথম দিনের মত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য রাথং গ্লেসিয়ার অবধি হেঁটে যাচ্ছিলাম। ভূবিদ্যার ছাত্র বলেই, জায়গাটা দেখে বুঝতে পারছি, যেখান দিয়ে হাঁটছি, সেটা মোরেন জোন। অর্থাৎ কোনো এক সময় এখানে গ্লেসিয়ার ছিল, কিন্তু এখন সেই তুষার-নদী পিছিয়ে গেছে, তাই তার বয়ে আনা ছোট, মাঝারি মাপের পাথর এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পাশে ইন্দ্রনীল স্যার ছিলেন, উনি এখানে আসছেন প্রায় বছর কুড়ি আগে থেকে। বললেন, সেই সময় গ্লেসিয়ার এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকেই শুরু হয়ে যেত। তারপরেও আধঘণ্টা হাঁটার পরে, গ্লেসিয়ারের দেখা পেয়েছিলাম। খুব কম করে হলেও সে তুষার নদী এক-দেড় কিলোমিটার পিছিয়ে গেছে গত ২০ বছরে।
এর জন্য কারা দায়ী? উত্তরটা খুব সহজ। আপনি তো জানেনই, আমিও জানি একটু আধটু। এর জন্য সেই মানুষগুলো দায়ী, যারা ঘোড়াকে চিপসের প্যাকেট খাওয়ায়। অবিশ্বাস্য লাগছে তো? লাগবে না, একটু গভীরভাবে বিষয়টাকে তলিয়ে দেখলেই।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সাথে আমরা সকলেই কমবেশি যুক্ত। এবং এটা এমনই একটা জায়গা, যেখানে খুব সহজেই দেখিয়ে দেওয়া যায়, আমি কতটা সুখে আছি, বাস্তবটা যতই তার চেয়ে আলাদা হোক না কেন। যখনই আপনি দেখছেন, ওমুক গতমাসে রুপিন পাস ট্রেক করে এল, তমুকে কেদারকান্ত কিংবা সিংগালি পাস করে ফিরে এল, যাওয়ার ইচ্ছে জাগল আপনারও। গোলটা বাঁধে এখানেই। টিভি, কানের দুল, মোবাইল, ঘড়ির সঙ্গে যেদিন থেকে এই ট্রেকটাও পণ্য হয়ে গেল। সেদিন থেকেই একদল মানুষের আমদানি হল, যারা শুধুমাত্র কিছু জায়গার ছবি দেখে, সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে। তাদের না আছে সেই শারীরিক সক্ষমতা, না মানসিক ভাবে সেই উচ্চতায় পৌছতে পেরেছে, যেখানে গেলে পায়ে হেঁটে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হবার চেষ্টাটুকু অন্তত করা যায়।
ভারতবর্ষের যে কোনো তীর্থস্থান, যেখানে পুণ্য অর্জনের বাসনায় যুগে যুগে মানুষ ছুটে গেছে, সবগুলো জায়গারই একটা বিষয় মিল আছে। সব তীর্থেই পুণ্য লাভ হয়, দুর্গম পথে হেঁটে পাহাড়ের উপরে কোনো এক জায়গায় পৌঁছে। আসল পুণ্য ওই কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে কোনোদিনই হয়নি, হবেও না। পুণ্য বা সোজা হিসাবে আত্মচেতন, অর্থাৎ নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে এই সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা এই যাত্রাপথেই মিলে যায়। এই যে আত্মদর্শন বা আত্মচেতন, যা মানুষের জীবনে একান্তভাবে প্রয়োজনীয়, তা উপলব্ধির অন্যতম এক সহজ আর চালু উপায় হল ট্রেকিং।
এর পাশাপাশিই আরো একদল মানুষ যুগে যুগেই আছে, যারা সারা পৃথিবীটাকেই নিজের ঘর ভেবেছে, আর তার টানে বারবার বেড়িয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে। সেই দুর্নিবার প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতির বৈচিত্র দেখার, আবিষ্কার করার বাসনায় তারা পায়ে হেঁটেই চষে বেড়িয়েছে পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি। এরাই ট্রেকার।
এই যে ট্রেক বিষয়টা পণ্য হয়ে গেল, তা কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টানো নয়। বছর ছয়েক আগেও ট্রেক করতেন হাতে গোনা কিছু মানুষ। আর এখন, সেই যে ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা দুম করে ‘বুক নাও’ বোতামটা টিপে দিলেন, ঘুড়ি আর তাঁর হাতে রইল না। যাবার আগের দিন অবধি তিনি একদিনও মাঠে যাবেন না একটু দৌড়াদৌড়ি করতে, একটা প্রবন্ধও পড়বেন না সেই জায়গাটা সম্বন্ধে জানতে। তারপর একদিন দুম করে হাজির হবেন, সেই স্বপ্নের মত জায়গাটায়। সেই জায়গার অবস্থান, জৈব-চক্র, আবহাওয়া, পরিবেশ কোনোকিছু সম্পর্কেই তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই, এবং যেটা সবচেয়ে ভয়ের তা হল, সেই জায়গাটি সম্পর্কে তার মনে কোনো ভালোবাসা বোধেরও জন্ম হয়নি, কারণ তিনি তো ‘ট্রেক’টি কিনেছেন। আর কে না জানে, কেনা জিনিসের প্রতি অধিকারবোধ জন্ম নিলেও, ভালোবাসা জন্মায় না। ভালোবাসা থাকে কেবল অর্জিত জিনিসের প্রতি।
এবার শুরু হল, পায়ে হাঁটা পথ বা ট্রেকরুট। এই শহুরে ফুলবাবুর পিঠে শুধুমাত্র একটা জলের বোতল, আর দুটি চিপসের প্যাকেট। বাকি সবকিছুই পয়সা দিয়ে কেনা মালবাহক আর খচ্চরের পিঠে। এবার সেই বাবু হাঁটছেন, একশ মিটার উচ্চতা ভেঙেই হাঁপাচ্ছেন আর খিদে পেলে চিপস খাচ্ছেন। একসময় তো প্যাকেট খালি হল, ফুলবাবু সেটাই করলেন, যেটা নিজের শহরে করে থাকেন। হেলাভরে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিলেন খাদের দিকে। পিছনে আসছিল মালবাহক খচ্চর। সেও এতদিনে এ জিনিসের সঙ্গে অভ্যস্ত, তাই নির্বিকারভাবে মুখে নিয়ে চিবোতে শুরু করল।
ট্রেকটা যারা পণ্য করে দিচ্ছে, তারা অত্যন্ত নৃশংসভাবেই করছে। এতটাই নৃশংস যে মনে গভীর সন্দেহ জাগে, তাদেরও আদৌ কোনোরকম আত্মচেতন হয়েছে কিনা। আদিগন্ত সবুজ একটা বুগিয়ালের উপর কী করে কারোর ইচ্ছা হতে পারে, ব্যবসা এবং শুধুমাত্র ব্যবসার কারণে ৫০টা তাঁবু দিয়ে জায়গাটার সৌন্দর্যই পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে! সেই তাঁবুর মধ্যে মজুত আছে স্লিপিং ব্যাগ, ম্যাট থেকে শুরু করে সবকিছু। ট্রেকার খালি গিয়ে পৌঁছতে পারলেই হল।। যে বিন্দুমাত্র কষ্ট না করেই সে জায়গায় পৌঁছে গেল শুধুমাত্র কিছু টাকা খরচের বিনিময়ে, সে কোনোদিন সেই জায়গার মাহাত্ম্য বুঝবে না। সে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিক ফেলবেই।
এই পয়সার বিনিময়ে শ্রম, প্রকৃতি, অভিজ্ঞতা এবং কিছুক্ষেত্রে মাহাত্ম্য কিনে নেবার মরণখেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতিই। এজেন্সির মাধ্যমে শীর্ষ স্পর্শ করা যায়, হিমালয়ের এমন শৃঙ্গগুলোতেও জমে উঠছে আবর্জনার স্তুপ। এভারেস্টের বেসক্যাম্পেই জমছে টন টন বিয়ারের ক্যান, ফুয়েল ক্যান, প্লাস্টিক আরো হাজার রকম নন-বায়োডিগ্রেডেবেল আবর্জনা। পাহাড়ের যে নিজস্ব একটা পরিবেশ ছিল, তা ক্রমশ আরো বেশি করে ধবংসের দিকে এগিয়ে চলেছে।
যা ছিল মানুষের অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা ধংসের জায়গা, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ সেইখানে পৌঁছে, সেই জায়গাটাকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ভয় হয়। পৃথিবীর এই সামান্য কিছু জায়গায়, প্রকৃতি যেখানে মানুষের ব্যভিচারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তাও ক্রমেই ব্যবসা আর পণ্যায়নের গ্রাসে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়!