বহুকাল আগে, ফ্যাতাড়ু কবি পুরন্দর ভাটের মুখ দিয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য বলিয়েছিলেন –
দু-দুখানি নিতম্ব দুরু দুরু কাঁপে
পিঁপড়া কামড় দিয়া যায় কোন ফাঁকে
লাল আছে, ডেঁয়ো আছে, আরও আছে হায়
ঠাকুরের নামে পোঁদ লক কিয়া যায়।
‘ব্যাড ভার্স’ বা আপাত-অর্থহীন কথা ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। নিজের ভেতরের একপ্রকার অন্তর্ঘাত থেকেই জন্ম নেয় এসব লেখা। যা সচেতনভাবেই অভিঘাত তোলে পাঠকের মনে। পুরন্দর ভাট লিখেছিলেন। আর রোদ্দুর রায় গাইছেন গান। একজন লেখার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাঙালির রক্ষণশীলতাকে ধাক্কা দিলেন, আর রোদ্দুর রায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে জুড়ে দিলেন অশিষ্ট শব্দ, সুর ভেঙেচুরে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটালেন।
আরও পড়ুন
মাসে আয় লক্ষাধিক, পিছিয়ে নেই বাঙালি ইউটিউবাররাও
রোদ্দুর রায় হাসির পাত্র। খোরাকেরও। তাঁর গানের ভঙ্গিতে, কথায়, উচ্চারণে মানুষ বিরক্ত হয়, মজা পায়। বেশিরভাগ লোকই বলেন, ‘ট্রেন্ডিং’ হতে চেয়ে তাঁর এমন হাবভাব। স্রেফ ‘ফুটেজ’ খাওয়ার জন্য। এক অর্থে দেখলে খুব ভুলও নয়। একজন মানুষ নিজের মতো বেসুরো গাইছেন, অঙ্গভঙ্গি করছেন, নাচছেন, গালাগাল দিচ্ছেন। আমাদের অভ্যস্ততায় তা মেনে না নেওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু যদি এমনটা হয় যে, নিজের আইডেন্টিটি বা স্বাধীনতাকে সোল্লাসে উদযাপন করতেই এমন করেন তিনি? লোকে সেসব শেয়ার করছে, ব্যাঙ্গও করছে। রোদ্দুর রায় কি এটাই চেয়েছিলেন? রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও, সস্তায় বাজার ধরতে? নাকি এসবের মাধ্যমে, নিজে ‘খোরাক’ হয়েও, কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছিলেন তিনি?
২০১৫ সালে, রোদ্দুর রায়ের একটি কবিতার বই বেরোয়। যদিও সেই বইয়ের লেখাগুলিকে ‘কবিতা’ বলা যায় কিনা, তা আলোচনার বিষয়। তবে, অজস্র খিস্তি-খেউড়-খিল্লির মধ্যেও এই বইয়ে থেকে গেছে এমন কিছু ইঙ্গিত, যা আপনাকে থমকে যেতে বাধ্য করবে। বইটির নাম ‘পরম ক্যাওড়া কাব্যগ্রন্থ’। উৎসর্গে লেখা –
সকল কেওড়া-প্রেমী মানুষ
ও মানুষ-সদৃশ প্রাণীদের
উচ্চাসনে বসায়ে
কাকভোরে
ধূপ-ধুনা-শঙ্খধ্বনি সহকারে
করজোড়ে
বেঁচেমরে
বিভৎস ও বিকট বিসদৃশভাবে
উচাটনময় উৎসর্গ
করা হইল।
একঝলক মনে পড়তে পারে ষাটের দশকের হাংরি কবি-লেখকদের বইয়ের উৎসর্গপত্রের কথা। যদিও দুইয়ের মধ্যে কোনো তুলনাই চলে না, তবু কোথায় যেন সেই কর্কশতা, সেই স্পর্ধা। আপনি যদি এই ধরণের কবিতায় অনভ্যস্ত হন, রোদ্দুর রায়ের বইটি পড়তে বিরক্ত লাগতে পারে আপনার। তবু, এরই ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে এমন কিছু তীব্র সত্যি, যা অবাক করে। দেখা যাক তেমনই একটি কবিতার অংশবিশেষ –
এখনো আমার নিজের কবিতা-বই
আধো-ঘুমে দেয় হঠাৎ হঠাৎ দেখা –
এখনো কখনো মিছিলের মেঘ দেখে
মনে পড়ে কোনো পূজা বা ইদের কথা।
................................................
আমিও সহিনু শতেক যাতনা কত -
সহিতে হইল হাড়গোড়-ভাঙা ক্ষত
এখনো তোমার রাস্তা-বাড়ির নিচে
মোর কঙ্কাল মোড়া আছে কালো পিচে...
আবার, অন্য একটি কবিতায় লেখা –
অনেক শরীর ঘেঁটে আজকাল
যৌনতা তেমন ভালো লাগে না – কেন কে জানে
ঝর্ণার জল আকণ্ঠ গিলে সেই জলে স্নান করতে
ইচ্ছে করে একা, খুব ভোরে উঠে, পাহাড়ে গিয়ে -
সাথে থাকুক – আমার শান্তি শুধু।
বিক্ষিপ্তভাবে হঠাৎ পড়লে বিশ্বাস করতে কষ্টই হবে, এগুলি ‘রোদ্দুর রায়ের’ লেখা। বইয়ের বেশিরভাগ লেখাই গড়ে উঠেছে ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’-এর ওপর ভিত্তি করে। ফলে সেগুলি কতটা কবিতা হয়ে উঠেছে, সে প্রশ্ন থাকবেই।
এ-বইয়েরও আগে, ২০০৭-০৮ সালের লেখাগুলি একত্রিত করে একটি বই বেরিয়েছিল তাঁর, নাম – ‘ছেলেবেলা আমাদের মামাবাড়ি টিয়া ছিলো।’ আলোচনা থাক, বরং কিছু কবিতাংশ তুলে ধরি –
খাঁচায় হাঁটিয়াছিলো, খাঁচা সে কাটিয়াছিলো
মহাকাশ রহস্য হয়তো ঘাঁটিয়াছিলোখাঁচা আর মহাকাশে আনমনা অবকাশে
দুটি চোখ পিটপিটে টিয়াটি দেখিয়াছিলোছেলেবেলা আমাদের মামাবাড়ি টিয়া ছিলো।
কিংবা,
কিছু প্রাণে রাগ ছিলো, গানে অনুরাগ ছিলো,
ভোররাত জানালায় ঊষাকালো কাক ছিলোদেখিয়া বেদনা-কাকে বইভরা দশ র্যাকে
পোকাদের খোকাগুলি হাতে লয়ে রং তুলিঅবুঝ আকাট প্রাণে নাহি বুঝি কোনো মানে
ভোর-ভৈরবী তানে, সবুজ রচিয়াছিলোসবুজের সুন্দরে, সময়ের ঘুণ ধরে, মিনমিনে মর্মরে
টিয়াটি বাঁচিয়াছিলো, কাব্য রচিয়াছিলো, পাকুড়ও পচিয়াছিলো,
ছেলেবেলা আমাদের মামাবাড়ি টিয়া ছিলো।
এ তো গেল কবিতার কথা। নিজে গান বাঁধেন, গেয়েও ফেলেন নিজেই। হাতে একটি উকুলেলে বা গিটার। কখনও দোতারা। সেই গানের কথাগুলি শুনলে চমকে উঠতে হয়। অথচ তাঁর ইমেজ এমনই হয়ে গেছে, যাই করুন না কেন, লোকে মজা হিসেবেই নেয়। ফলে রোদ্দুর রায় নামটির সঙ্গে সিরিয়াসনেস মেলানো যায় না সহজে।
তুলিও তুলে নিয়েছেন তিনি। এঁকেছেন একের পর এক ছবি। সাদা কাগজের ওপর কালো রঙে ফুটিয়ে তোলা একের পর এক অবয়ব আসলে বিক্ষুব্ধতারই প্রতীক। কিংবা, স্বাধীন কাশ্মীর, তিব্বত ও প্যালেস্তাইনের দাবিতে যখন হিমাচলের রাস্তায় শুয়ে একটা উকুলেলে হাতে গান ধরেন তিনি – ‘Yes man, a great evening, and this village / called globe’, আমরা খুঁজে পাই অন্য এক মানুষকে।
তিনি তাঁর প্রায় প্রত্যেক পোস্টের সঙ্গেই ‘moxapoem’, ‘moxasong’ ইত্যাদি লিখে থাকেন। কিন্তু কী এই মোক্সা মিউজিক? আমরা জানতাম না। প্রায় সব বাঙালির কাছেই অজানা ছিল ‘মোক্সা’ শব্দটি। রোদ্দুর রায় সেটির সঙ্গে পরিচয় করালেন আমাদের। মানুষের নিজের ভিতরের সত্তাটাকে সহজ-সরলভাবে বাইরে ছুঁড়ে দেওয়াই মোক্সা মিউজিকের লক্ষ্য। ভানহীন, সপাট। ‘The musical (or verbal and instrumental) approach, as observed, is an urge for exploring inner peace, passion and emotional harmony in the socially catered chaos based on the journey through various shades of individualistic and collective moods resulting in dramatic musical moments.’ – মোক্সা মিউজিক সম্পর্কে বলা হয় এমনটাই। সামাজিক বিধিনিষেধ, গণ্ডি, বাঁধাধরা পথ ভেঙে, নিজের মতো করে পরিবেশন করা গান। তাতে ব্যাকরণ মানা হোক বা না হোক, ক্ষতি নেই। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’-এর ধারণা বা চল নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে একাধিক শিল্পী এর প্রয়োগ করেছেন। বাংলাতেও বিরল নয় সেই উদ্যোগ। বলা যায়, মোক্সাগিরি সেই ধারারই নবতম সংযোজন।
রোদ্দুর রায় তাদেরই একজন। সার্বিকভাবে তাঁর অন্যান্য কাজের দিকে নজর দিলে, ‘খোরাক’ ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মানুষটাকে। পছন্দ হোক বা না হোক, থমকাতে হয়। খানিক ভাবতে হয়, কী বলতে চাইছেন তিনি। সন্দেহ তৈরি হয়। যে লোকটি সর্বজনস্বীকৃত ‘খিল্লিবাজ’, তিনি এমন সিরিয়াসও হতে পারেন? লোকটি তাহলে কী?
রোদ্দুর রায় এটাই চান। সবাইকে ধাঁধায় ফেলতে। কেউ ভাববে তিনি উন্মাদ, কেউ ভাববে তিনি নেশাগ্রস্ত, ফ্যাতাড়ুগোত্রীয় মানুষ। আবার কেউ ভাববে, তিনি উৎকট প্রতিবাদী, এভাবেই প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শানাচ্ছেন। আবার এভাবে গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজের বাজার – এমনও ভাবতে পারে কেউ। এই ভাবনাগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জুড়বে, লড়াই করবে, আর মাঝখান থেকে ‘মক্সা’ রোদ্দুর রায় আরও বেশি মজা কুড়োবেন। তাঁর নতুন নতুন ভিডিও বেরোবে, ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’র আগে তিনি জুড়ে দেবেন অশিষ্ট শব্দ, তাই নিয়ে ফেসবুক তোলপাড় হবে, ইউটিউব প্লাবিত হবে ভিউতে। রোদ্দুর রায় সমালোচনা-নিন্দা কিংবা স্তুতি নিয়েই বেঁচে থাকবেন বহাল তবিয়তে।