সামনে অতলান্ত সাগর। পিছনে ফ্যারাও-এর সৈন্য। জাহাজ নেই, নেই কোনো নৌকাও। কিন্তু এই সমুদ্র না পেরোলে যে পৌঁছানো যাবে না পবিত্র ভূমিতে। সমাধান পেতে ঈশ্বরের কাছেই শরণাপন্ন হলেন তিনি। আর তাঁর প্রার্থনাতেই দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল লোহিত সাগর। তৈরি হল পথচলার রাস্তা। সমুদ্রের তলদেশ দিয়েই হেঁটে লোহিত সাগর পেরোলেন তিনি ও তাঁকে অনুসরণকারী অজস্র মানুষ।
বুক অফ এক্সোডাসের মোজেসের (Moses) এই কাহিনি কম-বেশি সকলেরই জানা। জুডাউজম অর্থাৎ ইহুদিদের অন্যতম প্রধান প্রফেট মোজেস। মোজেসের কথা ও কাহিনি খানিক ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বাইবেল এবং কুরানেও। কিন্তু কে এই মোজেস? একাধিক ধর্মে উল্লেখিত হওয়া এমন এক চরিত্র কি সত্যিই ছিল বাস্তবে? তবে তাঁর আসল পরিচয় কী? এধরনের একাধিক প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে মোজেসের কথাতে।
ইজরায়েলের পুরাণ অনুযায়ী, মোজেস মিশরবাসী এক ইহুদি মহিলার সন্তান। তবে মিশরের সম্রাট সমস্ত ইহুদি সদ্যোজাতদের হত্যার আদেশ দিলে তিনি নীল নদের জলে ভাসিয়ে দেন ছোট্ট মোজেসকে। নদীর জলে ভেসে চলে মোজেসকে উদ্ধার করেন মিশরের রাজকন্যা বাত্যা। তিনিই মোজেসের জন্মদাত্রী জোশিবেদকে নিযুক্ত করেন তাঁর পরিচর্যার জন্য। অর্থাৎ ফ্যারাও-এর রাজপ্রাসাদেই, নিজের মায়ের পরিচর্যায় বেড়ে ওঠেন মোজেস। অন্যদিকে বাত্যা হয়ে ওঠেন তাঁর পালিতা মা।
এমনটা সত্যি হয়ে থাকলে মিশরের সিংহাসনের অধিকারী হয়ে ওঠার কথা মোজেসের, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এবার একটু চোখ রাখা যাক সমকালীন বাস্তব ইতিহাসে। ইহুদি পুরাণ অনুযায়ী, মোজেসের জন্মের সময় মিশরের রাজা ছিলেন ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিস।
দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যুর পরই সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় মিশরে। বহু ইতিহাসবিদের মতে, জন্মগত অধিকারের দিক থেকে সিংহাসনের মূল অধিকারী ছিলেন ক্রাউন প্রিন্স থুটমোসে (Thutmose)। তবে আশ্চর্যজনকভাবেই তাঁর বদলে সিংহাসনে বসেন রামেসিসের আরেক সন্তান আখেনাতেন। অন্যদিকে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে যায় থুটমোসের নাম। অনেক ইতিহাসবিদই বিশ্বাস করেন, থুটমোসেকে হত্যা করেই সিংহাসনে চেপেছিলেন আখেনাতেন। তবে সে-সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি, মেলেনি কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও।
তবে থুটমোসে যে বাস্তব চরিত্র ছিলেন, তা মিথ্যে নয়। কারণ, আখেনাতেন-এর খোদাই করা এক ওয়াইন জারের গায়েই লেখা রয়েছে রামেসিস এবং তাঁর ভাই থুটমোসের কথা। এখানেই দ্বিতীয় তত্ত্বটি তুলে ধরেন গবেষকরা। আখেনাতেনের হাতে রাজ্যপাঠ তুলে দিয়ে দেশ ছাড়েননি তো থুটমোসে?
হ্যাঁ, সেই সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় কীভাবে? আর এই সম্ভাবনা ধরেই পথ হাঁটা শুরু করেন একদল এটিমোলজিস্ট বা শব্দতাত্ত্বিক। আখেনাতেন-এর ওয়াইন-জার অর্থাৎ সুরাপাত্রটিকেই হাতিয়ার করে নিয়েছেন তাঁরা। সেখানে থুটমোসের সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘ট্রু সন অফ কিং’ অর্থাৎ ‘সত্যিকারের রাজার পুত্রসন্তান’। মিশরীয় ভাষায় পুত্রসন্তান কথাটিই লেখা হয় ‘মোসে’ হিসাবে। গ্রিক উচ্চারণে যা হয়ে ওঠে ‘মোসিস’।
সেই হিসাবে দেখতে গেলে থুটমোসের নামটিও আদতে মিশরীয় চন্দ্র এবং বিচারের দেবতা থুটের নামের অনুকরণেই রাখা। অন্যদিকে আখেনাতেন ছিলেন সূর্যদেব আতেনের পূজারি। সেখান থেকেই কি তবে বিবাদের সূত্রপাত। যে বিবাদের কারণে সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল থুটমোসেকে। ‘থুট’ অর্থাৎ চন্দ্রদেবতার নাম বর্জন করে হয়ে উঠতে হয়েছিল ‘মোসে’। যা কিনা কথ্য ভাষায়, উচ্চারণে বদলে গিয়ে ‘মোসেস’ বা ‘মোজেস’ রূপ নেয়?
এই তত্ত্ব বেশ জনপ্রিয় মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদদের কাছে। অবশ্য এই ঘটনারও প্রমাণ মেলেনি কোনো। তবে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে পাঁচ খণ্ডের একটি ফিকশন সিরিজ ‘রামেসিস’। পরবর্তীতে যদি এই তত্ত্ব সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার নেই কিছুই। দেশ থেকে নিজের ভাই-এর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে, অনুগামীদের নিয়েই হয়তো থুটমোসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইজরায়েলে। হয়ে উঠেছিলেন ইহুদিদের বিচারের ‘দেবতা’। ঠিক ‘থুট’-এর মতোই। ইহুদি পুরাণেও যে বর্ণিত রয়েছে তিনিই প্রবর্তন করেছিলেন নীতির। তেমনটা হলে, এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই মিশরই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের জন্মস্থান। এ এক আশ্চর্য রহস্যই বটেই…
তথ্যসূত্রঃ
১. Moses, Wikipedia
২. Was the Egyptian Crown Prince Thutmose the real Moses?, Seig Lu, Mysteries Unresolved
Powered by Froala Editor