“ইউনেস্কো-র বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষাবিদই সারা পৃথিবীজুড়ে বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষার কোনো বিকল্প হয় না। এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা ভীষণভাবে প্রয়োজন। এখন আমাদের শিক্ষা চাই, নাকি ইংরেজি শিক্ষা চাই – এই সংশয়ের মধ্যে পড়ে যান অনেকেই।” বলছেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র একটি বিতর্ক উঠে এসেছে, বাংলা মাধ্যমে (Bengali Medium) পড়াশোনা করে কি আদৌ পেশাগত জগতে সফল (Professional Success) হওয়া সম্ভব? বিতর্কটি নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই সংশয় অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে, আর তার ফলেই আজ রাজ্যজুড়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা কমে আসছে। কলকাতা শহরে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। এমনকি গ্রাম-মফস্বলেও একের পর এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলেও বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি শুরু হচ্ছে ইংরেজিতে পঠনপাঠন। তবে সত্যিই কি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে পেশাগত জগতে সফল হওয়া যায় না?
সাহিত্যিক যশোধরা রায়চৌধুরীর কথায়, “আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতেই হবে, বাঙালি কিংবদন্তিদের প্রায় সকলেই কিন্তু বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন। আজও আমার পরিচিত অনেকেই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে দেশের মধ্যে এবং দেশের বাইরেও সুপ্রতিষ্ঠিত।” তবে পাশাপাশি তিনি বলছেন, “প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও হয়তো অনেকের মধ্যেই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা নিয়ে একটা হীনমন্যতা থেকে যায়। তাই তাঁরাই আবার নিজেদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করছেন।” সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে জনৈক রেডিও সঞ্চালক মন্তব্য করেছেন, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে কর্পোরেট জগতে সাফল্য পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে আরেক রেডিও সঞ্চালক তথা অভিনেতা সায়ন ঘোষের বক্তব্য, “তিনি নিজে যেমন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে এই মাধ্যমে এসেছেন, সফল হয়েছেন; তেমনই আমি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেও তো সফল হয়েছি। আমার মতো অনেকেই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে সফল হয়েছেন। তাই সাফল্যের যে সিঁড়িগুলো তিনি দেখেছেন, আমিও দেখেছি। তাতে বলতে পারি, এখানে পড়াশোনার মাধ্যমটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।” সায়নের কথায়, “বাংলা এবং ইংরেজি উভয় মাধ্যমে পড়াশোনা করেই অনেকে সফল হয়েছেন। আবার অনেকে ব্যর্থও হয়েছেন। সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে একজন পড়ুয়া কতটা শিখছেন এবং কতটা পরিশ্রম করছেন, তার উপর।”
প্রায় একই কথা বলছেন প্রযুক্তি সংস্থা আইডিয়েশন টেকনোলজির কর্ণধার সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমি নিজে পুরোদস্তুর কর্পোরেট জগতের মধ্যেই আছি, এবং আমি তো বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেই এই জায়গায় আসতে পেরেছি।” কর্পোরেট জগতে পড়শোনার মাধ্যমটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই মনে করছেন তিনিও। “এই বিষয়ে জাপান তো সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। সম্পূর্ণ মাতৃভাষায় পড়াশোনার উপর নির্ভর করেই জাপানি উদ্যোগপতিরা আজ সারা পৃথিবীতে সফল।” বলছিলেন সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। তবে পেশাগত জগতে ইংরেজি ভাষা জানার একটা প্রয়োজন রয়েছে, সে-কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন তিনি।
অধ্যাপক পবিত্র সরকারও বলছেন, “সারা পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশগুলো নানারকম শর্ত তৈরি করে দেয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা তেমনই একটা শর্ত। সেটাকে অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করলেই ইংরেজি শেখা যায় না, এটা মনে করারও তো কোনো কারণ নেই।” পবিত্রবাবুর কথায় উঠে এল লেখক নীরদ সি চৌধুরীর নাম। পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র এবং অমিয় সরকারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেও তাঁরা যে শুধু নিজেদের বিষয়েই দক্ষতা অর্জন করেছেন এমন নয়। ইংরেজি ভাষাতেও তাঁরা সমান সাবলীল ছিলেন। “আমি নিজে পূর্ববঙ্গের একটি প্রত্যন্ত এলাকার বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছি। তারপর বৃত্তি নিয়ে গিয়েছি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে। আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। ইংরেজি ভাষা শিখতে তো হয়েছেই, কিন্তু শিখে নিতে কোনো সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়নি।”
আরও পড়ুন
মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবি, আন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসেছিল পৃথিবীর যেসব দেশ
আসলে বিষয়টা শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং পেশাগত জগতে সাফল্যের নয়, এমনটাই মনে করছেন যশোধরা রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, “অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের সঙ্গে এখন বাংলা মাধ্যমে পড়ার অনুষঙ্গ তৈরি হয়েছে। ফলে ডিপ্রাইভড ও হ্যাভ নটস দের সাথে বাংলা মিডিয়াম একীভূত হয়ে গেছে।” একদিকে বাংলা মাধ্যম স্কুল মানেই তার সাধারণ পরিচয় সরকারি স্কুল, অন্যদিকে বিভিন্ন বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়াশোনার আকাশছোঁয়া খরচ। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ইংরেজি মাধ্যম হয়ে উঠছে সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখার একটি চিহ্ন। অধ্যাপক পবিত্র সরকারের মতে, “এই বিভেদ উনিশ শতক থেকেই ছিল। উনিশ শতকে ভদ্রলোক এবং ছোটোলোক বিভাজন তৈরিই হয়েছিল ইংরেজি জানাকে অক্ষ করে।” তবে কেবল ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা কখনোই সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে না, বলছেন অধ্যাপক সরকার। তাঁর কথায়, “এই যে শ্রেণিবিভাজন তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, এতে সমাজে নানা স্তরের মানুষের ভূমিকার কথাই ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে মানুষটি মাঠে ফসল ফলান, তাঁর সেই ফসল ফলানোর শিক্ষাটাকে কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি তাঁরও যে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন আছে, প্রথাগত শিক্ষার উদ্দেশ্য যে শুধুই কর্পোরেট জগতে চাকরি পাওয়া নয়, সেটাও মনে রাখা হয় না। অথচ এ-কথা ভুললে চলবে না, অ্যাটোম বোম বানানোর চেয়ে ফসল ফলানো আমাদের সভ্যতার জন্য অনেক বেশি জরুরি।”
আরও পড়ুন
ইতালির গ্রাম হয়েও মাতৃভাষা ভিন্ন, কী রহস্য লুকিয়ে এই বিচিত্র ‘প্রদেশে’?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশের ১৪টি কলেজে মাতৃভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ, থাকছে বাংলাও