গত শতাব্দীর ছয়ের দশক। তুরস্কের (Turkey) ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন পড়ুয়া গবেষণার কাজে গেছিল সে দেশের উরফা অঞ্চলে। লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা টিলায় পর্যবেক্ষণের কাজ চলাকালীন হঠাৎই তাদের নজরে আসে কয়েকটি চুনাপাথরের ফলক। কৌতূহলবশে সামান্য নেড়েচেড়ে দেখে তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসে যে, এগুলি সম্ভবত মধ্যযুগের কোনো সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষ। ফিরে এসে একটি গবেষণাপত্রে সে বিষয়ে দুয়েক কথা উল্লেখ করে কাজ শেষ করে ফেলে তারা। কিন্তু সেদিন যদি আরেকটু আগ্রহ দেখাতেন, তাহলে হয়তো খোঁজ মিলত পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রার্থনালয়ের।
অন্তত এমনটাই মনে করতেন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস স্মিট (Klaus Schimdt)। পড়ুয়াদের অভিযানের প্রায় তিরিশ বছর পরে তাঁর হাতে আসে গবেষণাপত্রটি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, কোনো সাধারণ সমাধি নয়, এর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে অন্য রহস্য। যার নাম গোবেকলি তেপে (Gobekli Tepe), বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়াবে ‘পাহাড়ের পেট’। তড়িঘড়ি তিনি চলে আসেন তুরস্কতে। ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু হয় গবেষণা। তখনও অবশ্য জানতেন না, মাটির তলায় কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। ক্রমে বুঝতে পারেন, যে প্রত্নতত্ত্বের জন্য তিনি সবকিছু ভুলে উরফা শহর থেকে ৬ মাইল দূরে দিনরাত এক করে খেটে যাচ্ছেন, তার বয়স প্রায় এগারো হাজার বছর! ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের থেকেও ৬০০০ বছর বেশি বয়স। চাকা আবিষ্কার হয়নি তখনও। স্মিটের মতে ‘গোবেকলি তেপে’ প্রাচীনতম মন্দিরের আশ্চর্য উদাহরণ।
আনুমানিক ৯৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যার নির্মাণ। তখনও চলছে প্রস্তর যুগ, অধিকাংশ মানুষই যাযাবর গোষ্ঠীর। সেই সময়ে কিনা স্থায়ী মন্দির? এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল স্মিটের। খননকার্য থেকে যে ধরনের পাথরফলক পাওয়া গেছে, তাতে অন্তত এটা পরিষ্কার যে এখানে মানুষ বসবাস করত না। শয়নকক্ষ, স্নানাগার ইত্যাদির সন্ধানও মেলেনি। আয়তনেও খুব বেশি বড়ো নয় স্থানটি। ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো ১৫ মিটারের ২০টি পাথরফলক দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারে। নিশ্চয়ই গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ মাত্র কয়েকজনের জন্য বাড়িঘর বানাবে না? অথচ স্থাপত্যের প্রবেশপথটি দেখে মনে হয় যেন এখানে নিত্য যাতায়াত ছিল মানুষের। কয়েকটি ফলকে বিভিন্ন পশুপাখির মূর্তি খোদাই করা। সব মিলিয়ে দৃঢ় হতে থাকে স্মিটের ধারণা।
তাঁর গবেষণায় উঠে আসে আরো একটি তথ্য। শুধু উরফা নয়, মিশর, ইজরায়েল থেকে বহু মানুষ আসতেন এখানে। কয়েক হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া আজকের দিনে মামুলি ব্যাপার, কিন্তু প্রস্তর যুগে নিশ্চয়ই সহজ ছিল না বিষয়টি। একমাত্র তীর্থদর্শনের জন্যই এত দূর যেতে পারে মানুষ। স্মিট ‘মন্দির’ নির্মাণকার্যের যে নমুনা সামনে রেখেছেন, তাও রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। কয়েকশো মানুষের চেষ্টায় প্রায় দশ বছর লেগেছে মন্দিরটি তৈরি হতে। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। কৃষিকাজের জন্য মানুষ স্থায়ী বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে আরো কয়েক হাজার বছর পরে। তাহলে গোবেকলি তেপে কি বিস্ময়করভাবে ব্যতিক্রম? সেক্ষেত্রে তো মানবসভ্যতার ইতিহাসকে দেখতে হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। কীভাবে যে ওই যুগে এত ভারি পাথরকে কেটে মন্দিরের রূপ দেওয়া হল সেটাও আশ্চর্যের। আবার, গোবেকলি তেপে-র পাথরফলকগুলি পাওয়া যায় প্রায় অক্ষত অবস্থায়। অনুমান, অধিবাসী যাওয়ার আগে মাটির নিচে পুঁতে রেখে যায় মন্দিরের অংশগুলি। সেক্ষেত্রে প্রশংসা করতে হয় তাদের বুদ্ধিমত্তারও।
আরও পড়ুন
একের পর এক হেরিটেজ স্থাপত্য ধ্বংস রাজ্যে, দায়ী কে?
এই শতাব্দীর শুরু থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে গোবেকলি তেপে। কিছু সংবাদমাধ্যম তো একে ‘ধর্মের জন্মভূমি’ পর্যন্ত আখ্যা দিয়ে বসে। ধীরে ধীরে আগমন বাড়ে পর্যটকদেরও। দ্রুত ব্যবস্থা করা হয় সংরক্ষণের। দেশবিদেশের বেশ কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে সাজিয়ে দেওয়া হয় স্থানটি। ইউনেসকো থেকে ‘হেরিটেজ সাইট’ রূপেও ঘোষণা করা হয়েছে একে। ক্লাউস স্মিট অবশ্য বেশিদিন সেসব দেখার সুযোগ পাননি। ২০১৪ সালে মারা যান তিনি। তারপরেও কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী সম্ভবত আশেপাশে কয়েকটি বাড়িঘরও ছিল। গোবেকলি তেপে ছিল তার মধ্যমণি। তুরস্কের কয়েকজন প্রত্নতত্ত্ববিদ উরফার অন্যান্য অঞ্চলে খুঁজে পেয়েছে একই ধরনের আরো কয়েকটি স্থাপত্য। তাহলে কি সমগ্র উরফা জুড়েই ছিল স্থায়ী মানুষের বসবাস? এগারো হাজার বছর আগে ছোটো ছোটো গ্রামে বিভক্ত হয়ে বাস করত তারা? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে কিন্তু নতুন করে লিখতে হতে পারে মানবসভ্যতার ইতিহাস।
আরও পড়ুন
রাস্তায়-রাস্তায় ‘বই বেঞ্চ’, বিস্ময়কর স্থাপত্য বুলগেরিয়ায়
Powered by Froala Editor