এখন সবকিছুরই সংবাদমূল্য রয়েছে। বিগত কয়েকদিন যে খবরগুলি আমাদের আলোড়িত করছে, তা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। যা সম্ভবত আমাদের সব থেকে বেশি আলোড়িত করে, ‘ধর্ষণ’, তারই অভিঘাতে আমরা মানসিক বিপর্যস্ত। গতকাল দেশবাসী শিউরে উঠেছিল একটা খবরে। উন্নাও-এ তরুণীর ধর্ষণে অভিযুক্ত এক ব্যক্তি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তরুণীটির গায়ে। সেই দগ্ধ তরুণী দীর্ঘ পথ দৌড়ে হাজির হয়েছিলেন পুলিশের কাছে। এই-ই আমাদের দেশে। কয়েকদিন আগে হায়দ্রাবাদে মহিলা পশু চিকিৎসকের বীভৎস মৃত্যুর স্মৃতি এখনও দগদগে। তারই মধ্যে, আজ সকাল থেকে আরেকটি খবর নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। হায়দ্রাবাদ ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত চারজনকেই এনকাউন্টারকে গুলি করে হত্যা করেছে তেলেঙ্গানা পুলিশ। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, ওই চারজন নাকি অস্ত্র কেড়ে পালাতে চেয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে দুটি ঘটনাই একটি সুতোয় বাঁধা – ধর্ষণ এবং তার পরবর্তী ক্রিয়া। এবং, দুটি ঘটনাই আলাদা। আজকের ঘটনাটিই দেখা যাক। প্রথম কথা, যে অভিযুক্ত, তারও অধিকার আছে বিচার পাওয়ার। এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ, এর জন্যেই সংবিধান। তারা অপরাধ স্বীকার করে থাকলেও, তাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। সেখানে এনকাউন্টার করে অভিযুক্তদের হত্যা করা সংবিধান, আইন, মানবতা – কোনোকিছুর নিরিখেই খুব ভালো বিজ্ঞাপন নয়।
পুলিশ যে যুক্তি দিচ্ছে, তা কতটা খাঁটি – এ-নিয়েও প্রশ্ন থাকে। আমরা অতীতের এমন একাধিক ঘটনা জানি। এমনকি, প্রচুর সাহিত্য-উপন্যাসেও বারবার উঠে এসেছে এই প্রসঙ্গ। এ এমন একটি সত্য, যা সবাই জানে। অথচ নতুন-নতুন করে তা আমাদের সামনে আনা হয়। আমরাও তা বিশ্বাস করার ভান করি। চারজন অভিযুক্ত নাকি পুলিশের অস্ত্র কেড়ে তাদের আক্রমণ করেছিল। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে, অস্ত্রচালনায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত পুলিশের থেকেও কোনোদিন অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ না নেওয়া অভিযুক্তরা অনেক বেশি দক্ষ। এটাও অপদার্থতা। আর প্রত্যেককে গুলি করে মারতেই কেন হল, পুনরায় ধরা গেল না, তার কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রশ্নটি ঘুরপাক খেলেও সরাসরি বলা যাচ্ছে না যে, এটি একটি ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া এনকাউন্টার নয়। পূর্বপরিকল্পনা? উত্তর দিচ্ছি না।
কিন্তু বিষয় হল, তেলেঙ্গানা পুলিশের এই ঘটনা, যা দিয়ে তাদের গাফিলতি নানা দিক দিয়ে স্পষ্ট হয়, তারপরেও তারা বীরের তকমা পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে অভিনন্দন ও উল্লাসের বন্যা। সংসদে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় তেলেঙ্গানা পুলিশকে স্যালুট জানিয়েছেন। এই ভয়ঙ্কর উল্লাসের পিছনে যে একটা যন্ত্রণা ও ক্ষোভ কাজ করছে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ক্ষোভের চরিত্র যদি কোনোদিন নির্ণয় করতে বসেন কোনো সমাজবিজ্ঞানী, তাহলে তার মধ্যে কী খুঁজে পাবেন? যে প্রতিহিংসা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে, তাও কিন্তু কম হিংস্র নয়। ধর্ষকরা যে খুবই ঘৃণ্য তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সমাজের থেকে পাওয়া বিকার, পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতাই তারা বহন করে। সেই সমাজই যেন বিকৃত উল্লাসে মেতেছে এই মৃত্যুতে।
এই কথা বললেই অনেকে রে রে করে তেড়ে আসবেন। তাঁরা বলবেন, বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা কোথায়! এই তো উন্নাও-এর তরুণী বিচার চাইতে গিয়েছিল। গ্রেপ্তারও হয়েছিল অভিযুক্ত। বেলে মুক্তি, সেও আইনি পথে। মুক্তির পরেই প্রমাণ লোপাটের জন্য সে তরুণীকে পুড়িয়ে মারতে গেল। অর্থাৎ বিচারপ্রক্রিয়ার মাঝখানেই আক্রান্ত হলেন সেই ধর্ষিতা তরুণী। যেক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থা একজন ধর্ষিতাকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেখানে প্রলম্বিত বিচারের মানে কী! তার চেয়ে খতম করার পন্থাই ভালো! মুশকিল হল, খতম বা নিকেশ করার এই পন্থা খুব আধুনিক নয়। তাহলে এত আইন-আদালত কেন? তাহলে এত সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারের কথাই বা কেন? মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সওয়াল করে প্রত্যেকটি উন্নত রাষ্ট্রই। চায় নতুন সুযোগ। সব অপরাধের ক্ষমা হয় না। কিন্তু পরিবর্তনের যদি কোনো উপায়ই না থাকে, যদি একটি ঘৃণ্য অপরাধের বিনিময়ে তার থেকেও বেশি বা সমতুল্য হিংস্রতা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে এখানে মানবিকতা কোথায়? রাষ্ট্র যখন তার ব্যর্থতা বা সাফল্যে এমন প্রতিক্রিয়া দেয় আর আমরা উল্লসিত হই, তখন এই প্রশ্নও জাগে মনে – আমরা এমন রাষ্ট্রই চাই? তাহলে আমরা যখন আক্রান্ত হব, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? কোন মানবিকতার খোঁজ করব? উত্তর পাচ্ছি না। আপনারা পেলে জানাবেন।