সুন্দরবন ভারতের নবীনতম অঞ্চল, যার গঠনপ্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এর বিস্তৃতি। ১৮২৯-৩০ সালে ডাম্পিয়ার ও হজেস নামে দুই ব্রিটিশ সাহেব এর একটা সীমানা চিহ্নিত করেছিলেন, যেটি ডাম্পিয়ার-হজেস সীমানা (Dampier-Hodges Line) নামে পরিচিত। উত্তর চব্বিশ পরগনার টাকি শহর থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ পর্যন্ত একটি কাল্পনিক রেখা বরাবর এই সীমানা নির্ধারিত।
ঘন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ সমাচ্ছন্ন সুন্দরবনে বসতির বিস্তার শুরু ১৭৭০ সাল থেকে। অরণ্য অভ্যন্তরে জনপদ আগ্রাসনের সেই ইতিহাসে যাওয়ার আগে এখানকার ভূমিগঠনের স্বাভাবিক ইতিহাস বুঝে নেওয়া খুব জরুরি। ভৌগোলিক দিক থেকে সুন্দরবনের অবস্থান গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ ভূখণ্ডে। এই ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই বোঝা যায় সুন্দরবনের উৎপত্তির ইতিহাস। সুউচ্চ হিমালয় পর্বত থেকে গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র এবং তাদের সহনদীর মিলিত পলিভার এখানে সঞ্চিত হয়েছে। সেই তিল তিল সঞ্চয়ে সমুদ্র মোহনায় ক্রমশ জেগে উঠেছে অনেক পলিদ্বীপ। ওদিকে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা এই দ্বীপ সমাহারকে স্থিত করেছে। নদী আর সমুদ্রের এই যৌথতায় জন্ম নিয়েছে আজকের সুন্দরবন। গঙ্গার শাখানদী আর বহু জোয়ারি নদী এখানে পরস্পর যুক্ত হয়ে যেন এক নদীজাল তৈরি করেছে। এইসব নদী পলি বয়ে আনে সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রের জোয়ারি জল ছুটে যায় নদীর দিকে। নদীতে জল বেড়ে যায়। দুকূল ছাপিয়ে সে জল ছড়িয়ে পড়লে পলি থিতিয়ে পড়ে দুপাশের নিচু জমিতে। প্রতি দিনের এই নিত্য খেলায় দ্বীপভূমি উঁচু হতে হতে স্থায়ী হয়।
ভূমিগঠনের এই স্বাভাবিক শাশ্বত নিয়ম রুদ্ধ হো ১৭৭০ সাল থেকে। প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর শুরু হল মানবিক নিয়মের প্রতিষ্ঠা। ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে অরণ্যের উত্তর সীমান্ত দিয়ে বসতির বিস্তার আরম্ভ হল বারুইপুর, ভাঙর, কুলপি, ক্যানিং, জয়নগর, পাথরপ্রতিমার স্থাপন দিয়ে। পরবর্তী সময়ে জঙ্গলের দক্ষিণায়ন চলতেই থাকল। হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁ, ক্যানিং, জয়নগর, মথুরাপুর, সাগর, কোথাও অরণ্যের এতটুকু অস্তিত্ব রইল না। ১৮৭৩ সালের পরবর্তী সময়ে অরণ্যের ওপর দখলদারি আরও দ্রুত হল কারণ এই সময় এখানে রেলপথের সম্প্রসারণ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে অধুনা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের বসতি চাহিদায় সাতজেলিয়া, ঝড়খালি, একের পর এক দ্বীপে জমি উদ্ধারের কাজ চলল। অবশেষে যখন অবাধে অরণ্য হাসিলের কাজ বন্ধ হল, দেখা গেল সুন্দরবনে বর্তমান ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪টিতে বসতির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। বিস্তৃত ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মাত্র ৪২৬৭ বর্গ কিলোমিটার এখন অরণ্যের অধিকারে।
বসতি স্থাপনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষিজমি স্থাপনের ইতিহাস। যে মানুষেরা এখানে জীবনযাপন শুরু করলেন, তাঁদের সবচেয়ে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল এখানকার ভূমিগঠনকারী বহতা নদীরা। জোয়ারের নোনা জল বসতজমি চাষের জমি যাতে প্লাবিত করতে না পারে তার জন্য দুই তীর বরাবর নদীর সমান্তরালে তৈরি হল উঁচু মাটির দেওয়াল। এইভাবে শুরু হল নদীবাঁধের ইতিহাস। শুরু হল প্রাকৃতিক নদীকে শাসনে রাখবার ইতিহাস। এই নিয়ন্ত্রিত পথে প্রবাহিত নদীর কোনোভাবেই দুপাশের জমিতে পলি সঞ্চয়ের সুযোগ থাকে না। কিন্তু অনবরত সে জলের ধারায় পলি আসছেই। ফলত নদীর গর্ভেই সে পলির সঞ্চয় হতে থাকে। নদীগর্ভ ভরাট হলে জলতলও ওপরে ওঠে। আবারও উপচে যেতে চায় তটবন্ধন। মানুষ তার সম্পদ রক্ষায় বাঁধের উচ্চতাও বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া তো চলবেই। আর তাই সুন্দরবন অঞ্চলের এক অভূত ভূদৃশ্য হল জমির থেকে অনেক উঁচুতে নদী বয়ে চলেছে। কিন্তু বাঁধের একটা সহনক্ষমতা আছে। জলের চাপে কখনও বাঁধ ভাঙবেই আর নোনা জলে ভরে যাবে চারপাশ। জমি থেকে সে জল আবার নদীতে সরানোর উপায় নেই কারণ নদী যে অনেক উঁচুতে।
আরও পড়ুন
আলোচনায় ‘উপেক্ষিত’, ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে ধুঁকছে শঙ্করপুরও
এ এক অসম লড়াই। অপরিকল্পিত জমিগঠনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ভরা কোটালে তাই বাঁধ ভাঙে। আর যখন ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে সুন্দরবনের বুকে, প্রবল জলোচ্ছ্বাস, সঙ্গে তুমুল হাওয়ার দাপটে মাটির বাঁধ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। বিঘার পর বিঘা জমি সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে যায় বহু বছরের জন্য, হয়ত বা চিরকালের জন্য। ২০০৯ সালে আয়লার তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন এখনও সুন্দরবনে রয়ে গেছে। তারপর এল আমফান। আবারও বিপর্যয়। সেই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই ইয়াস। বহু বাঁধ ভেঙে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম জলমগ্ন। এ তো সুন্দরবনের পরিচিত দৃশ্য। অথচ এই দৃশ্য বদলে দেওয়ার জন্য কত পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। ত্রাণের টাকা আসে। তার হিসেব আসে না। কোথাও গিয়ে মনে হয়, এই বিপর্যয় টিকিয়ে রাখারও কি কোনো পরিকল্পনা আছে? সুন্দরবনের মানুষেরা এই লড়াই লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়, হয়তো হতাশও হয়, ক্রুদ্ধ হয়। তবু আবার ফিরে যায় অসহায় অনিশ্চিত জীবনযাপনে।
আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতিতে আয়লা-আমফানকেও ছাপাল ইয়াস? আশঙ্কা সুন্দরবনকে ঘিরে
তবে কি এভাবেই বেঁচে থাকা। এটাই কি ভবিতব্য? অনেক মানুষ মনে করেন কংক্রিটের এমন স্থায়ী বাঁধ তৈরি করতে হবে যার ঔদ্ধত্য নদীকে নত করে রাখবে। আয়লার পর এমন পরিকল্পনার কথাও হয়েছে। কিন্তু নদী আছে মানেই পলি আছে, পলি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া আছে। তার স্বাভাবিকতায় ছেদ পড়লে প্রকৃতির যে প্রবল প্রতিরোধ আসে তাকে জয় করবার ক্ষমতা মানুষের নেই। এই সহজ সত্য উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বিপরীতে, বাঁধ না থাকলে মানুষই বা বাঁচবে কী করে। এই মাটি ছেড়ে কোথায় যাবে তারা। তাই প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার কথা ভাবতে হবে। চওড়া বাঁধ থাক। তার অর্ধেক জুড়ে থাকুক ম্যানগ্রোভের সারি। টানা বাঁধের মাঝে মাঝে থাকুক ফাঁক যাতে জোয়ারের জল বেরিয়ে যেতে পারে ( spillway)। সুন্দরবন জুড়ে এমন খালব্যবস্থা (canal network) গড়ে উঠুক যাতে সুষম নিকাশের বন্দোবস্ত হয়। যে ম্যানগ্রোভের প্রাচীর ঘূর্ণিঝড়কে প্রতিহত করে তাকে রক্ষা করতেই হবে। স্যাটেলাইট ইমেজ দেখলেই বোঝা যায়, কীভাবে চোরা কারবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে অরণ্য। বছর বছর প্রকল্প ঘোষণা আর ত্রাণের উৎসব শেষ হোক। এমন পরিকল্পনা হওয়া দরকার যেখানে ভূমিপুত্রের মতামত দেওয়ার অধিকার থাকবে। গোটা সুন্দরবন জুড়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এ সমস্যা যাবে না। আর কিছুতেই যার হিসাব মেলে না, আজ এত বছর পরেও প্রতিটি গ্রামেই কেন ফ্লাড শেল্টার তৈরি করা গেল না। ফ্লাড শেল্টারেই বসানো হোক একাধিক নলকূপ। এ কি খুব কঠিন কাজ? নাকি একটা ঘূর্ণিঝড়, বাঁধ মেরামত, ত্রাণ, এন. জি. ও, টাস্ক ফোর্স, এবং আবার একটা ঘূর্ণিঝড়, বাঁধ মেরামত, এভাবেই চলবে এবং এভাবেই।
আরও পড়ুন
১৩৭ বছর আগে তোলা এই ছবিই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফ
(লেখক বেলঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভূগোল শিক্ষক)
তথ্য উৎস :
১.নীললোহিত বিশেষ পরিবেশ ও মনন সংখ্যা।
২. শুধু সুন্দরবন চর্চা জানুয়ারি ২০১৯।
৩. শুধু সুন্দরবন চর্চা জানুয়ারি ২০২০।
৪. রুদ্রাক্ষ সাহিত্য পত্রিকা ১৪১০।
৫. কোরক সাহিত্য পত্রিকা ১৪০৭।
Powered by Froala Editor